1. admin@channeldurjoy.com : admin : Salahuddin Sagor
  2. news.channeldurjoy@gmail.com : Editor :
উত্তাল মার্চ- বাঙ্গালিয়ানার চিরস্থায়ী গোড়াপত্তন। - চ্যানেল দুর্জয়
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৪ অপরাহ্ন

উত্তাল মার্চ- বাঙ্গালিয়ানার চিরস্থায়ী গোড়াপত্তন।

  • প্রকাশিত : সোমবার, ১ মার্চ, ২০২১

সম্পাদকীয়।। একাত্তরের মার্চ ছিল উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর, ভয়ংকর। ‘পাকিস্তান’ নাটকের শেষ দৃশ্যটি তখন মঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছে। ‘পূর্ব পাকিস্তান’ তখন ‘বাংলাদেশ’। সব জায়গায় বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়ছে। পাকিস্তান রয়ে গেছে কেবল কাগজে-কলমে। ৭ মার্চ ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বাংলার অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চূড়ান্ত ফয়সালার ইঙ্গিত দিলেন, আবার দিলেনও না। বাংলাদেশের প্রশাসন চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় উড়ে এলেন। ১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া একান্ত বৈঠক হলো এক ঘণ্টা। ১৭, ১৯ ও ২০ মার্চও দুজনের মধ্যে কথা হয়। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই ছিল নিজ নিজ পরামর্শক টিম। তারা জানাল, কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট একটা ফরমান জারি করবেন।
এরপর কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটল। শেখ মুজিবের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা যুবনেতা আবদুর রাজ্জাককে ডেকে বললেন, ‘তোমরা এখনো বসে আছ? তোমাদের নেতা কিন্তু আপস করে ফেলেছে।’ (লেখকের নেওয়া আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার) যুবনেতারা তৎপর হলেন। ২২ মার্চ রাতে তাঁরা ধরনা দিলেন শেখ মুজিবের কাছে। শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁদের আলাপচারিতা উঠে এসেছে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজের বয়ানে:
২২ মার্চ রাতে আমরা ৩২ নম্বরে গেলাম। রাত তখন ১০টা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে খাটে শুয়ে আছেন। আমরা মেঝের ওপর বসলাম। তিনি এক হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে কাত হয়ে আধশোয়া অবস্থায় কথা বলতে লাগলেন। আমি বললাম, ‘স্বাধীনতা ঘোষণা করে দ্যান।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘অনেক ভেবেছি, কোথাও সাপোর্ট নাই। ইন্ডিয়া সাপোর্ট দিতে পারে, নাও পারে। রাশিয়া দিবে কি না জানি না। আমেরিকা সাপোর্ট দিবে না। চায়না-হুজুরকে (মওলানা ভাসানী) বলছি, নেগেটিভ।’ ঠিক এই সময় সিরাজ ভাই (সিরাজুল আলম খান) উঠে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন ৪০-৪৫ মিনিট পর। বললেন, ‘কনফেডারেশনের প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? এতে পাকিস্তান থাকবে, কিন্তু ইয়াহিয়া এটা মানবে না। সুতরাং, আমাদের কাজটা হয়ে যাবে।’ বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে সিরাজ ভাইকে বললেন, ‘অ, তুই বুঝি মোস্তাকের (খন্দকার মোশতাক আহমদ) কাছে গেছিলি?’ (লেখকের নেওয়া শাজাহান সিরাজের সাক্ষাৎকার)
একটা চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে ছাত্রসমাজের একটি অংশের চাপ ছিল। ছাত্রদের দাবি ছিল, গণ-আন্দোলন নিয়ে কোনো আপস চলবে না। কেন্দ্রে ক্ষমতা নেওয়াটা আপস হিসেবে দেখার একটা সুযোগ ছিল।
২৪ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায় আওয়ামী লীগের আলোচক দল ইয়াহিয়ার পরামর্শক দলের সঙ্গে আবার বৈঠক করে। ওই বৈঠকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ হতে হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়।
বেলুচিস্তানের ন্যাপ নেতা মীর গাউস বখশ বিজেঞ্জো নির্বাচনের আগে নির্বাচন নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। আলোচনায় পূর্ব পাকিস্তান প্রসঙ্গ উঠতেই ইয়াহিয়া বললেন, ‘আগে কিংবা পরে পূর্ব পাকিস্তানকে কেটে বাদ দিতেই হবে এবং এটাই যদি ঘটে, তবে ওদের কেন আরও দু-তিন বছর আমাদের রক্ত চোষার সুযোগ দেব?’ (বি এম কুট্টি সম্পাদিত ইন সার্চ অব সলিউশনস: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অব গাউস বখশ বিজেঞ্জো )
পূর্ব পাকিস্তান যে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে, এই অনুমান অনেকের মধ্যেই ছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ ছিল অন্ধকারে।
একাত্তরের মার্চে সংকট যখন বাড়ছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে পিপলস পার্টি ছাড়া অন্যান্য দলের অনেকেই ঢাকা এসেছিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খান এবং পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মীর গাউস বখশ বিজেঞ্জো ১৩ মার্চ ঢাকায় আসেন। ১৪ মার্চ তাঁরা শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর ধানমন্ডির বাসায় দেখা করেন। বিজেঞ্জোর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়:
আপনি খোলামনে আপনার পরিকল্পনা আমাদের জানাবেন, কারণ পশ্চিম পাকিস্তানে যারা আপনার রাজনৈতিক ভূমিকা সমর্থন করে, আমরা তাদের অন্যতম। আপনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এবং আপনার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া উচিত। আপনি যদি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তাহলে বুঝতেই পারছেন আমরা কী দারুণ সমস্যায় পড়ব।
এ কথা শুনে শেখ সাহেব খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তাঁর চোখে পানি। তিনি প্রশ্ন করলেন: কে কাকে বলছে পাকিস্তান না ভাঙতে? তোমরা যারা কংগ্রেসে ছিলে (স্বাধীনতার আগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁদের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিয়ে) আমাকে বলছ, যে কিনা গোঁড়া মুসলিম লীগার এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মত্যাগ করেছিলাম? কী নির্মম পরিহাস?
ওয়ালি খান স্বভাবসুলভ রসিকতা করে শেখকে স্মরণ করিয়ে দিলেন: আমরা তখন আপনাকে ভারত ভেঙে পাকিস্তান না বানানোর অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু আপনি পাকিস্তান বানালেন। এখন আমরা হাতজোড় করে ভিক্ষা চাইছি, পাকিস্তান ভাঙবেন না। কিন্তু আপনি বলছেন যে আপনি পাকিস্তান ভাঙবেন। আপনারা অতীতের এবং বর্তমানের সব মুসলিম লীগার—আসলেই একটি বিশেষ প্রজাতি।…
শেখ মুজিব বললেন: আমি আপনাদের বলতে চাই, তারা (ইয়াহিয়া গং) আমার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, যদি এতে পাকিস্তান ভেঙেও যায়। পাঞ্জাব আমাদের ক্ষমতায় আসতে দিবে না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিজেঞ্জো পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য শেখ মুজিবের প্রস্তাব অনুযায়ী দুই সংবিধানের প্রসঙ্গ তুলতে গেলে ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘আপনার বন্ধু মুজিব যদি পথে না আসে, আমার সেনাবাহিনী জানে কীভাবে পথ বের করে নিতে হয়।’ ওয়ালি খান ও বিজেঞ্জো ২৪ মার্চ শেষবারের মতো দেখা করতে গেলে শেখ মুজিব তাঁদের বলেছিলেন, ‘ভালো হয় যদি আপনারা দুজন ঢাকা ছেড়ে চলে যান। সেনাবাহিনী দুদিনের মধ্যেই আমাদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
আওয়ামী লীগের পক্ষে ড. কামাল হোসেন ২৬ পৃষ্ঠার একটি খসড়া সংবিধান ২৩ মার্চ বেলা সোয়া ১১টায় প্রেসিডেন্টের পরামর্শক দলের কাছে দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ শেখ মুজিব এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কিছু এলাকায় জনতার ওপর সেনাবাহিনীর হামলার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতাল ডাকেন। এটাই ছিল ২৫ মার্চ কালরাতের আগে শেখ মুজিব বা আওয়ামী লীগের শেষ কর্মসূচি।
রাতে সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। শেখ মুজিব বন্দী হন। যে কমান্ডো দলটি শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল, তার দায়িত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার) জেড এ খান। দ্য ওয়ে ইট ওয়াজ বইয়ে তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ২৩ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারের কর্নেল আহমদের কাছ থেকে শেখ মুজিবকে পরদিন অথবা তার পরদিন গ্রেপ্তার করার নির্দেশ পান। ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গ্রেপ্তারের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ সকালে জেনারেল আবদুল হামিদ খান কর্নেল খানকে স্মরণ করিয়ে দেন, শেখ মুজিবকে অবশ্যই জীবিত ধরতে হবে। কর্নেল খান তিনটি গ্রুপে তাঁর সেনাদের ভাগ করে তাদের মেজর বিলাল, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন ও ক্যাপ্টেন সাঈদের অধীনে ন্যস্ত করেন। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন সাঈদ শেখ মুজিবের বাড়ির আশপাশ রেকি করেন। রাত ১১টায় দলটি এয়ারফিল্ড থেকে রওনা হয়। পরে কয়েকটি ব্যারিকেড সরিয়ে তারা ধানমন্ডির বাড়িিটতে পৌঁছায়। অপারেশনটি কর্নেল খান বর্ণনা করেছেন এভাবে:
নিচতলা সার্চ করা হয় কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় না।
অনুসন্ধানী দল ওপরতলায় যায়। যেসব কামরা খোলা ওখানে কাউকে পাওয়া গেল না। একটা কামরা ভেতর থেকে আটকানো। আমি ওপরতলায় গেলে একজন আমাকে বলে, বন্ধ কামরািটর ভেতর থেকে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমি মেজর বিলালকে বন্ধ কামরার দরজা ভেঙে ফেলতে বলে ক্যাপ্টেন সাঈদ এসেছে কি না দেখার জন্য নিচতলায় নেমে আসি।…
আমি ক্যাপ্টেন সাঈদকে গাড়িগুলো কীভাবে লাইন করতে হবে, সে ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছিলাম, তখন প্রথমে একটা গুলির শব্দ, তারপর গ্রেনেড বিস্ফোরণ এবং শেষে সাবমেশিনগান থেকে ব্রাশফায়ারের আওয়াজ শুনতে পাই। ভাবলাম, কেউ বুঝি শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। আমি ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকে ওপরতলায় গিয়ে যে ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সেটার দরজার সামনে কম্পিত অবস্থায় শেখ মুজিবকে দেখতে পাই। আমি তাঁকে আমার সঙ্গে যেতে বলি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবেন কি না। আমি অনুমতি দিই। তিনি কামরািটর ভেতর গেলেন। সেখানে পরিবারের সবাই আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসেন। আমরা গাড়িগুলো যেখানে, সেদিকে হাঁটতে থাকি। ক্যাপ্টেন সাঈদ তখনো ওঁর গাড়িগুলো ঘোরাতে সক্ষম হননি। আমি ইস্টার্ন কমান্ডে একটা রেডিওবার্তা পাঠাই যে শেখ মুজিবকে ধরা গেছে।
মুজিব এ সময় আমাকে বললেন, তিনি ভুলে পাইপ ফেলে এসেছেন। আমি আবার তাঁর সঙ্গে ফিরে আসি। পাইপ নিয়ে নেন তিনি। এর মধ্যে শেখ মুজিব নিশ্চিত হয়ে গেছেন, আমরা তাঁকে হত্যা করব না। তিনি বললেন, আমরা তাঁকে ডাকলেই হতো, তিনি নিজে থেকেই বেরিয়ে আসতেন। আমরা তাঁকে বলি, আমরা তাঁকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে ওকে গ্রেপ্তার করা হবে। আমরা ফিরে আসতে আসতে ক্যাপ্টেন সাঈদ ওর গাড়িগুলো লাইন করে ফেলে। শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে ওঠানো হয়। আমরা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাত্রা করি।
শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছিল। শুরু হয়ে যায় ‘মুক্তিযুদ্ধের’ সশস্ত্র প্রতিরোধ পর্ব, যার শুরুটা হয়েছিল ইপিআর হেডকোয়ার্টারে এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। কিন্তু এই প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মার্চ মাসজুড়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছিল উত্তপ্ত। তরুণেরা একটা স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য টগবগ করে ফুটছিলেন এবং রাজপথে ডামি রাইফেল নিয়ে মিছিল করছিলেন। ২৫ মার্চ মাঝরাতে তাঁরা সবাই যে যেদিকে পারলেন গা ঢাকা দিলেন। অনেকের গন্তব্য হলো ভারত সীমান্তের দিকে।
২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া কিংবা না দেওয়া নিয়ে পরে জল অনেক ঘোলা করা হয়েছে। শেখ মুজিব নিজেও তাতে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বক্তৃতা দেওয়ার একপর্যায়ে বলেন, ২৫ মার্চ রাতে তিনি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরী এ রকম একটি বার্তা পেয়েছিলেন—এমন কথা একাত্তর সালে কেউ শোনেননি। রেডিও পাকিস্তানের চট্টগ্রামে অবস্থিত কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্রটিকে বেতারের একদল কর্মী ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র নাম দিয়ে কিছু অনুষ্ঠান চালান এবং সেখান থেকে স্বাধীনতার কয়েকটি ঘোষণা পাঠ করা হয়। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নানের বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে:
২৬ মার্চ…আমরা কালুরঘাট গিয়ে জানতে পারলাম যে জিয়াউর রহমান (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর) বোয়ালখালী থানার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। আমরা মেজর জিয়াউর রহমানকে বোয়ালখালী থানার কুসুমডাঙ্গা পাহাড়ের নিকট তাঁর জওয়ানদেরসহ দেখতে পাই; তাঁকে শহরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাই এবং শহরসংলগ্ন এলাকায় শিবির স্থাপন করার জন্য অনুরোধ জানাই। তবে ২৭ মার্চ তিনি কালুরঘাট আসবেন বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কাপ্তাই থেকে আগত ক্যাপ্টেন হারুন ও ১৫০ জন ইপিআর মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে একত্র হন।
কালুরঘাট থেকে চলে আসার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে রেডিও মারফতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা প্রচার করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৬ মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করি। প্রচারে আমাকে সহযোগিতা করেন রেডিও অফিসের রাখাল চন্দ্র বণিক, মীর্জা আবু মনসুর, আতাউর রহমান কায়সার, মোশাররফ হোসেন প্রমুখ এমপিএ ও এমএনএ।
২৭ মার্চ বিকেলে মেজর জিয়াউর রহমানও রেডিও মারফত স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ঘোষণার বক্তব্য নিয়ে জনমনে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দেয়। তাই সেদিন রাত্রে আমি মীর্জা আবু মনসুর ও মোশাররফ হোসেন ফটিকছড়িতে অবস্থানরত সাবেক মন্ত্রী এ কে খান সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পুনর্ঘোষণার জন্য তিনি একটি খসড়া করে দেন। আমরা ফটিকছড়ি থেকে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সেন্টারে উপস্থিত হই। সেখানে মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে আমি এ কে খান কর্তৃক লিখিত খসড়াটি দিই। পুনরায় ২৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকীর ভাষ্যও প্রায় একই রকমের। তিনি তাঁর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘২৭ মার্চ জিয়া বেতার ভাষণ দেন, নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন, মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। এটা আওয়ামী লীগার ও জনগণকে বিভ্রান্ত করে। খবরটি শুনে এ কে খান বলেন, এটাকে সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে মনে করা হতে পারে এবং দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো সমর্থন পাওয়া যাবে না। তিনি ইংরেজিতে একটা খসড়া তৈরি করে দেন। জিয়া ভুল বুঝতে পারেন এবং নতুন খসড়াটি পাঠ করেন, যাতে উল্লেখ করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর পক্ষে তিনি ঘোষণা দিচ্ছেন।’
অনেকেই মনে করেন, স্বাধীনতার একটা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ বুঝি বৈধতা পায় না এবং এই ঘোষণা শেখ মুজিব নিজ কণ্ঠে না দিয়ে থাকলে তিনি যে মুক্তিযুদ্ধের নেতা, এটা প্রমাণ করা যায় না। এই ধারণা থেকেই সম্ভবত পরবর্তী সময়ে এর নানা রকমের ভাষ্য তৈরি হয়।
২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পরিকল্পনায় নির্দিষ্ট একজন মাত্র রাজনীতিবিদকে হত্যার করার সিদ্ধান্ত ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষের। তাদের লক্ষ্য ছিল ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের’ প্রধান পরিকল্পনাকারী ও লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া। হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন অনেকেই, কিন্তু সুনির্দিষ্ট টার্গেট ছিলেন একমাত্র মোয়াজ্জেম। ২৫ মার্চ সূর্য ওঠার আগেই ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় তাঁকে ঘাতকেরা পিস্তল দিয়ে পর পর পাঁচটি গুলি করে এবং মৃতদেহটি সঙ্গে করে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ আর পাওয়া যায়নি।
২৫ মার্চের সামরিক অভিযান সম্পর্কে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। কিছু কিছু বিষয় ছিল ব্যাখ্যার অতীত, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এডিসি আরশাদ সামি খান তাঁর থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান এইড: লাইফ, পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিকস বইয়ে কিছু তথ্য দিয়েছেন। অনেক কিছুই তিনি কাছে থেকে দেখেছিলেন:
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় উপস্থিত সামরিক হাইকমান্ড নিয়ে বৈঠক করে সবুজ সংকেত দিলেন। অপারেশনের জন্য ২৫ মার্চ তারিখটি ঠিক করা হলো। এ ছাড়া সিদ্ধান্ত হলো, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের অন্য সিনিয়র নেতাদের অক্ষত অবস্থায় জীবিত ধরতে হবে। ইয়াহিয়া জোরের সঙ্গে কথাটা কয়েকবার বললেন, তাঁদের অক্ষত এবং জীবিত ধরতে হবে এবং শক্তি যত কম ব্যবহার করে।
আমরা ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে রওনা হলাম। ২৫ তারিখ মধ্যরাতের পরপর আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা লম্বা তালিকা ধরে সামরিক অভিযান শুরু হলো। বিস্ময়ের ব্যাপার, শেখ মুজিব ও ড. কামাল হোসেন ছাড়া সবাই হাওয়া হয়ে গেলেন (কামাল হোসেন অবশ্য ধরা দিয়েছিলেন কয়েক দিন পরে)। পরে জানা যায়, তাঁরা ভারতে, প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, আসাম ও ত্রিপুরায় পালিয়ে গেছেন। তাঁদের এই গায়েব হয়ে যাওয়ায় সামরিক অভিযানের গোপনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। মনে হয়, শেখ মুজিব ও কামাল হোসেন ছাড়া সবাইকে পালিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ দুজনই বা থেকে গেলেন কেন? তাঁদের থেকে যাওয়া এবং তাঁদের নিয়ে ইয়াহিয়া কী করবেন, এটা কি পরিকল্পনার অংশ ছিল? পরে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে তাঁদের গ্রেপ্তার হওয়াটা নিশ্চিতভাবেই একটা পরিকল্পনার অংশ ছিল।
আমরা রাত সাড়ে ১০টায় রাওয়ালপিন্ডি পৌঁছালাম।…আমরা যখন জানতে পারলাম শেখ মুজিব ও ড. কামাল হোসেন গ্রেপ্তার হয়েছেন, ইয়াহিয়া জানতে চাইলেন, তাঁরা অক্ষত কিনা। তারপর নির্দেশ দিলেন বিচারের জন্য তাঁদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আসতে।
পরদিন সকালে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভুট্টো শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে সাংবাদিকদের বললেন, ‘পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।’
লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামাল মতিনউদ্দীন তাঁর ট্র্যাজেডি অব এররস বইয়ে লিখেছেন:
ভুট্টোর রাজনৈতিক সহকর্মী গোলাম মোস্তফা খাঁর বন্দী শেখ মুজিবের সঙ্গে ভুট্টোর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। ভুট্টোকে দেখে শেখ মুজিব কৌতুক করে বলেন, ‘তুমহারা বাপ তো গায়া’ (তোমার বাপ তো চলে গেছে)। শেখ মুজিব স্পষ্টতই ইয়াহিয়ার চলে যাওয়া প্রসঙ্গে ইঙ্গিত করেছিলেন। ভুট্টো নীরবে অপমানটুক হজম করলেন।
একাত্তরের সংকট ও সংঘাতে শেখ মুজিবুর রহমান, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো—এই তিনজনের ভূমিকার অনেকটাই অজানা। যেভাবে পাকিস্তান ভাঙল এবং বাংলাদেশ জন্ম নিল—এতে এঁদের তিনজনের কার দায় কতটুকু, তা নিয়ে রহস্য আছে, আছে বিতর্ক। ইয়াহিয়া খান নিজেকে একজন ‘অনেস্ট ব্রোকার’ মনে করতেন। এ জন্য তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচনটির আয়োজন করতে পেরেছিলেন। একসময় তাঁর মনে হলো, শেখ মুজিব ও ভুট্টো দুজনই তাঁকে ঠকিয়েছেন এবং নিজেরা সাফ-সুতরো থেকে তাঁকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন। তাঁরা নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর কাছে বীরের মর্যাদা পেয়েছেন এবং তিনি (ইয়াহিয়া) পরিণত হয়েছেন একজন খলনায়কে।
২৫ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করার আদেশ দিয়ে ইয়াহিয়া নিশ্চিন্ত মনেই ইসলামাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন। ভুট্টো তাঁর পদক্ষেপকে সমর্থন দেওয়ায় তাঁর কাঁধ থেকে যেন একটা বোঝা নেমে গেল। তিনি ভাবলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তান’ ছিল একটা কঠিন সমস্যা এবং শিগগিরই সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। তিনি ভুট্টোর কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করলেন। এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। এক সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। তিনি দুটো বড় বেলুন হাতে নিলেন। তারপর একটা করে বেলুন লাথি মারলেন আর বললেন, ‘হিয়ার গোওজ মুজিব অ্যান্ড হিয়ার গোওজ ভুট্টো।’ তিনি ভাবতেও পারেননি মুজিবের কারণে পূর্ব পাকিস্তানে কী ভয়াবহ আগুন জ্বলবে এবং ভুট্টো তলে তলে কী কারসাজি করবে। (থ্রি প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড অ্যান এইড: লাইফ, পাওয়ার অ্যান্ড পলিটিকস)
১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান দুই টুকরো হলো। পূর্ব পাকিস্তান হলো স্বাধীন বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গেল পাকিস্তান নামে। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় বীরের মর্যাদা পেলেন। পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর উত্তরণ ঘটল প্রধান নেতা হিসেবে। ইয়াহিয়া খান চলে গেলেন পর্দার অন্তরালে, চিরতরে।
১৯৭১ সালের রাজনৈতিক সংঘাত এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্ম হওয়াটা বাংলাদেশে একটি অনিবার্য রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখা হলেও পাকিস্তানে এ ধরনের পরিণতির জন্য সাধারণ মানুষ মানসিকভাবে তৈরি ছিল না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান ‘ভাঙার’ জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং এর পেছনে ভারতের ‘উসকানি’কে যতই দায়ী করুক না কেন, পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের উপলব্ধি অন্য রকমের। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে এক জনমত জরিপে জানা যায়, পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিক ‘ঢাকার পতন’, অর্থাৎ বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটাকে পাকিস্তানের জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা হিসেবে মনে করেন। পাকিস্তান ভাঙার জন্য সবচেয়ে বেশি মানুষ কিন্তু দায়ী করেন ভুট্টোকে। জনমত জরিপে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ভুট্টো পাকিস্তান ভাঙার জন্য প্রধানত দায়ী। ইয়াহিয়া খানকে দায়ী মনে করেন ২৪ শতাংশ মানুষ। মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ পাকিস্তানের বিপর্যয়ের জন্য শেখ মুজিবকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
পাকিস্তানে ১৯৭০-৭১ সালে ভুট্টোকে নিয়ে যে মাতামাতি ছিল, তা থিতিয়ে আসতে বেশি সময় লাগেনি। একটা কারচুপির নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। শেষরক্ষা হয়নি। তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

আজকের দিন-তারিখ

  • শনিবার (বিকাল ৩:৪৪)
  • ২০শে এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১১ই শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরি
  • ৭ই বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)

এই মুহুর্তে সরাসরি সংযুক্ত আছেন

Live visitors
138
3257699
Total Visitors