সালাহ্উদ্দীন সাগর।। ঝিনাইদহের বারোবাজার দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। এখানে রয়েছে সুলতানি আমলের ৫০০ থেকে ৮০০ বছরের পুরনো অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের যে স্থানে বারোবাজার অবস্থিত, তার আশপাশে তিন থেকে চার কিলোমিটার ব্যাসার্ধের বৃত্ত আঁকলে যে স্থানটি ধরা পড়ে, তার মধ্যেই রয়েছে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।
এই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে আজ থেকে ৫০০ বছর আগে এই অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ সুলতানি জনপদ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শাসনামলে এই জনপদ ক্রমেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। গত শতকের আশির দশকে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বারোবাজার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন উঁচু মাটির ঢিবি খনন করে এসব অত্যাশ্চর্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করে। আশপাশের জনপদ সমতল থাকলেও শুধু এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো মাটির নিচে চাপা পড়েছিল।
এই এলাকায় সুলতানি আমলের ১৯টি মসজিদ মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে গলাকাটা মসজিদ অন্যতম। ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর ১৯৯২-৯৩ সালে খনন করে। খনন করার সময় শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইনের আমলের (৮০০ হিজরি) আরবি ও ফারসিতে লেখা কয়েকটি পাথর এখানে পাওয়া যায়। সেগুলো দেখে অনুমান করা হয়, মসজিদটি সুলতানি শাসনামলের তৈরি। একসময় এ জনপদে বাস করতেন প্রাচীন রাজারা।
ঘন গাছগাছালির ভেতর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর গলাকাটা মসজিদ। মসজিদের চারপাশ সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সামনে রয়েছে সুন্দর বেইসমেন্ট।
মসজিদের ছাদে রয়েছে ছয়টি গম্বুজ। ভেতরে রয়েছে দুটি কষ্টিপাথরের মিনার। মসজিদটি খনন করার সময় একটি হাতে লেখা কোরআন শরিফ ও একটি তলোয়ার পাওয়া যায়। সেগুলো মসজিদের ভেতরেই সংরক্ষিত আছে। চারটি ছয় কোণাকৃতি বড় মোটা পিলারের ওপর মূল মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে। পিলারগুলো ২৫ ফুট করে লম্বা। মসজিদের দেয়াল পাঁচ ফুট চওড়া। সামনের দিকে তিনটি দরজা রয়েছে। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি করে প্রবেশপথ ছিল। এগুলো ইটের জাল করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি দরজার ওপরে রয়েছে সুচালো খিলান।
মসজিদের পাশে রয়েছে গলাকাটা দিঘি। সেখান থেকেই এই মসজিদকে গলাকাটা দিঘি মসজিদ বা গলাকাটা মসজিদ বলা হয়। খান জাহান আলী (রহ.)-এর সমসাময়িক এই দিঘি বলে জনশ্রুতি আছে। এই দিঘি চারদিকের পারসহ ১২ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। দিঘির জলে হাঁসের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য খুবই চমৎকার। দিঘির শান্ত জল সুলতানি আমলের জৌলুস মনে করিয়ে দেয়। আগের দিনে বড় মসজিদ নির্মাণ করলে তার সামনে অজু-গোসলের জন্য এমন একটি দিঘি নির্মাণ করা হতো। তবে এই দিঘির নাম কেন গলাকাটা হলো সে সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে একজন অত্যাচারী রাজা ছিলেন। তিনি প্রজাদের বলি দিয়ে এই দিঘির মধ্যে ফেলে দিতেন। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা দিঘি। অনেকে মনে করে, দিঘির ওপর দিয়ে রাতে গলা কাটা ঘোড়া চলত। তাই মানুষ এর নাম দিয়েছে গলাকাটা দিঘি। এর থেকে মসজিদেরও নাম হয় গলাকাটা মসজিদ।