নিজস্ব প্রতিবেদ।।ককরোনা মহামারি চলাকালে দেওয়া প্রণোদনার অর্থ বিতরণ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম পেয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক আইএফআইসি ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে বিতরণ হওয়া ৮৩ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ নিয়ে করা অনিয়ম উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলের তদন্তে।
আইএফআইসি ব্যাংকের যে তিনটি শাখা থেকে এ ঋণ বিতরণ করা হয় সেগুলো হলো- মতিঝিলে অবস্থিত ফেডারেশন শাখা, গুলশান শাখা ও নারায়ণগঞ্জ শাখা। এসব শাখা থেকে বিতরণকৃত প্রণোদনা ঋণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে বলে তদন্তে বের হয়ে আসে।
করোনা মহামারি চলাকালে দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। স্বল্প সুদে দেওয়া প্রণোদনার এ ঋণের বিপরীতে প্রদত্ত সুদের অর্ধেক সরকার পরিশোধ করবে বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রণোদনার আওতায় ২০২০ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার।
ঘোষণা করা প্রণোদনা প্যাকেজে ৩০ হাজার কোটি টাকা বৃহৎ শিল্প এবং পরিষেবা খাতের জন্য ঘোষণা করা হয়। এ ঋণের আওতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে কার্যকরী মূলধন হিসেবে বিতরণ করে। ৯ শতাংশ সুদের মধ্যে গ্রাহক দেবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। বাকি অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে বলে নির্দেশনায় জানানো হয়। এ সুযোগের অপব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন গ্রুপ এবং ব্যাংকের বিরুদ্ধে।
বেশ কয়েকটি অভিযোগের ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রদত্ত ঋণের ওপর তদারকি করার নির্দেশ দেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। নির্দেশে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর জন্য ক্রেডিট ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার নির্দেশিকা অনুসারে প্রণোদনা ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করার জন্য ঋণগ্রহীতাদের ওপর নজরদারি জোরদার করতে হবে। দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি আকারে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।প্রণোদনার ঋণ বিতরণের সময় বেশিরভাগ বড় গ্রুপগুলো তাদের নেওয়া আগের ঋণের সুদ পরিশোধ ও ঋণ সামঞ্জস্য করার প্রবণতা লক্ষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার বিষয়টিও একাধিক ব্যাংকে পরিদর্শনের সময়ে চোখে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন শেষে প্রণোদনা তহবিল থেকে দেওয়া ঋণ বিতরণে অনিয়ম পায় কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। অনিয়ম করা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব ঋণের বিপরীতে সুদ হারের অর্ধেক দেওয়ার কথা ছিল সরকারের। সে সুদের ভর্তুকি বাতিল করা হয়েছে।তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, আইএফআইসি ব্যাংকের ফেডারেশন শাখা গত বছরের (২০২০ সালে) ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রণোদনা তহবিল থেকে কার্যকর মূলধন (ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল) হিসেবে আনোয়ার সিমেন্ট লিমিটেডকে ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিতরণ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করে এ ঋণের টাকা নিয়ে আনোয়ার সিমেন্ট অন্য ব্যাংকের ঋণ সমন্বয় করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, আনোয়ার সিমেন্ট প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে নেওয়া ঋণের ১ কোটি টাকা রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টের (আরটিজিএস) মাধ্যমে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে। এ ছাড়া আনোয়ার সিমেন্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আনোয়ার ইস্পাতের ট্রাস্ট ব্যাংকের হিসাবে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা জমা করে।
প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ সমন্বয় করে আনোয়ার সিমেন্ট। এ দুটি প্রক্রিয়া মাত্র দুদিনে সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠানটি।
ব্যাংকটির ফেডারেশন শাখা থেকে উত্তরা স্পিনিং মিলস লিমিটেডকে ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়। ব্যাঙ্গো মিলার্স লিমিটেডকে দেওয়া হয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া স্বল্প সুদের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ব্যাঙ্গো বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস লিমিটেডকে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা এবং ডিউরেবল প্লাস্টিক লিমিটেডকে দেওয়া হয় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোট ২০ কোটি ৯০ লাখ টাকা কোম্পানিগুলোকে কার্যকরী মূলধন হিসেবে দেওয়া হয়।
পরিদর্শক দলের রিপোর্টে বলা হয়, প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে বিতরণ করা এসব ঋণ কোম্পানিগুলো তাদের অন্যান্য ব্যাংকের হিসাব নম্বরে স্থানান্তর করে। এর কারণে প্রণোদনা ঋণের সঠিক ব্যবহার হয়েছে কি না, তা জানতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকেও এমন অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। প্রণোদনা তহবিল থেকে এসকিউ সেলসিয়াস লিমিটেডকে ১০ কোটি টাকা এবং সোনিয়া অ্যান্ড সোয়েটারস লিমিটেডকে ৫ কোটি টাকা কার্যকরী মূলধন হিসেবে বিতরণ করে ব্যাংকটির গুলশান শাখা।
পরিদর্শক দলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ শাখা থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া মোট ১৫ কোটি টাকা অন্যান্য ব্যাংকে থাকা আগের ঋণ সামঞ্জস্য করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে দেওয়া ঋণ অন্য অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে ঋণ পরিশোধের জন্য যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রণোদনা ঋণ পাওয়ার পর এসকিউ সেলসিয়াস লিমিটেড ঋণ সমন্বয় করতে বেসরকারি খাতের ডাচ-বাংলা ব্যাংক এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে স্থানান্তর করে।
সোনিয়া সোয়েটারস লিমিটেডের শ্রমিকদের বেতন ও মজুরি প্রদানের শর্তে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু শ্রমিকদের বেতন প্রদানে এ ঋণ ব্যবহারের কোনো প্রমাণ পায়নি পরিদর্শক দল।
আইএফআইসি ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখা থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় রনি নিট কম্পোজিট (প্রা.) লিমিটেডকে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং নিট কনসার্ন প্রিন্টিং ইউনিটকে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা কার্যকরী মূলধন হিসেবে বিতরণ করে।
প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করবে বলে জানায় কোম্পানি দুটি। তবে এ টাকা দিয়ে বেতন পরিশোধের কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল।
এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শাহ এ সারওয়ারের সঙ্গে। বেশ কয়েকবার মোবাইল ফোনে কল এবং মেসেজ দিয়েও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হয় আইএফআইসি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ মো. মঈনুদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণোদনা ঋণ বিতরণের বিষয়ে আমাদের ব্যাংকে একটি অডিট করেছে তবে কোনো অনিয়ম পেয়েছে কি না, এমন কোনো তথ্য আমার জানা নেই। ইতোমধ্যে প্রণোদনা ঋণের বেশিরভাগ সমন্বয় করা হয়েছে।’
ব্যাংকটির ফেডারেশন শাখার ব্যবস্থাপক জুলফিকার আলী বলেন, ‘আমরা অডিট শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, বিষয়টি নিয়ে আর কিছু বলতে পারছি না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রণোদনা ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। কিছু বড় ঋণগ্রহীতা পূর্ববর্তী ঋণ সামঞ্জস্য করার জন্য স্বল্প সুদের প্রণোদনা তহবিল ব্যবহার করেছে। যার ফলস্বরূপ তহবিলের সঠিক ব্যবহার হয়নি। তিনি আরও বলেন, স্বল্প সুদের প্রণোদনা তহবিলের যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি আরও জোরদার করা উচিত।