সম্পাদকীয়।।ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন মহসিন খান নামে একজন ব্যবসায়ী। বুধবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় আত্মহত্যা করেন তিনি। তার এই মৃত্যুর জন্য তিনি পরিবারে ভাঙন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, কাছের মানুষের অবহেলা এবং বন্ধু ও পরিচিতজনদের অসততাকে দায়ী করেছেন।
আত্মহত্যার আগে ফেসবুক লাইভে মহসিন খান যে কথাগুলো বলেছেন, এর ভেতর দিয়ে আমাদের সমাজে বিচ্ছিন্নতার সর্বগ্রাসী রূপটি অত্যন্ত স্বচ্ছ ও গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি মহসিন। একসময় আমি ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। আজকে লাইভে আসার কারণ হলো, আমার অভিজ্ঞতা মানুষের সঙ্গে শেয়ার করা। কিছুদিন আগে আমার খালা মারা গেছেন, তার এক ছেলে আমেরিকায় থাকেন। কিন্তু ছেলেটা আসেনি। এটা আমাকে দুঃখ দিয়েছে, কষ্ট দিয়েছে। আমার আরেক খালা মারা গেছেন, তার একটি ছেলে আমেরিকায় ছিল। তার তিনটা ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, তারা বর্তমানে ঢাকায় আছে। মায়ের দাফন কাফন করেছে। সেদিক দিয়ে বলব, এই খালা অনেকটা লাকি। আমার একটা মাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমি বাসায় একা থাকি। খালা মারা যাওয়ার পর আমার খুব ভয় করছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি, আমার মনে হয় না যে এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে, আমি মারা গেছি। গত করোনা শুরুর আগে থেকে আমি বাংলাদেশে আছি। একা থাকা যে কী কষ্ট; যারা একা থাকে তারাই বোঝে। আমার এখন পৃথিবীর মানুষের প্রতি কোনো আবেগ নেই। আমি প্রতারিত হয়েছি। আমি মানুষের কাছে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা পাই।
সবশেষ আমি নোবেল নামে একজনকে বিশ্বাস করি। যাকে আমি মিনারেল ওয়াটার প্লান্টের দায়িত্ব দিয়েছিলাম। কিন্তু দুই বছরেও সেই প্লান্টের যন্ত্র সে কেনেনি। পরে তার কাছে টাকা ফেরত চাইলে ঝগড়া হয়। এরপর সে দুই দফায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেয়। বাকি টাকা সে আমাকে দিচ্ছে না। মানুষ কেন এত লোভী হয়? পৃথিবীতে একটা জিনিস দেখলাম, ছেলে বলেন, মেয়ে বলেন, স্ত্রী বলেন, কেউ কারও নয়। আজকে যেভাবে তাদের দেখভাল করছেন, আগামীকালকে হয়তো পারবেন না।
এটা পরিবারের লোকজন মেনে নিতে পারে না। স্ত্রী ও পরিবারকে বুঝতে হবে- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয় কমে যায়। সন্তানদের বুঝতে হবে- বাবারা কষ্ট করেন, নিজে না খেয়ে সন্তানদের খাওয়ান। অনেকদিন থেকে আমি হতাশাগ্রস্ত। আমি যতটুকু করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। নিজের ওপর এতটাই বিতৃষ্ণা জন্মেছে যে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই। ভেতরে অনেক কষ্ট। আমার আত্মীয়সহ অনেকেই দেখছেন, কারও সঙ্গে যদি অন্যায় করে থাকি ক্ষমা করবেন।’
ফেসবুকে লাইভে এসে আত্মহত্যার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে আমাদের দেশে এ রকম একাধিক ঘটনা ঘটেছে। তাদের জীবনের গল্পটাও মহসিন খানের মতোই, অর্থাৎ তারাও নিঃসঙ্গতা ও বঞ্চনার শিকার। বর্তমানে সামাজিক বিপর্যয়ের কারণগুলো নিয়ে চিন্তা করতে গেলে যে বিষয়গুলো সামনে এসে দাঁড়ায় তার অন্যতম হলো যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে এসে একক পরিবার গঠন। সেই সঙ্গে রয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক সংস্কৃতি চর্চার অপ্রতুলতা। পারিবারিক সংস্কৃতির চর্চা না থাকলে সামাজিকতা বাড়বে না, বরং এর উল্টোটাই ঘটে। তা-ই হয়েছে। একটু পেছনে ফিরে তাকালেই আমরা যৌথ পরিবারের চিত্র দেখতে পাই।
তখন পুরো পরিবার একসঙ্গে বসবাস করত, সাময়িক মনোমালিন্য থাকলেও সুখে দুঃখে সবাই একসঙ্গে মিলেমিশে থাকত। আধুনিক নাগরিক জীবনে সেটা হয়তো এখন অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে যৌথ পরিবারের আবহ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হওয়াটা সমীচীন নয়। আমাদের এখন পারিবারিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক জীবনের নানা সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা যদি যৌথ পরিবারের আবহকে লালন করে পারস্পরিক বন্ধনকে আরও শক্ত করতে পারি তাহলে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে।