সম্পদকীয়: দেশীয় গ্যাস উৎপাদনে মন্থর গতির তথ্য নতুন নয়। বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে গ্যাস সংকটের কারণে দেশব্যাপী বিদ্যুৎ সংকট সৃষ্টি হওয়ায়। এ সংকট নিরসনে কী করে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যায়, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের চিন্তাভাবনা করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম চড়া। চাহিদা অনুযায়ী এর প্রাপ্যতা নিয়েও দেখা দিচ্ছে সংশয়। কারণ এ যুদ্ধ সব দেশকেই জ্বালানি সংকটে ফেলেছে। সব মিলে গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেল নিয়ে সারা বিশ্বেই সৃষ্টি হয়েছে এক কঠিন পরিস্থিতি।
এ বাস্তবতায় দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা।
স্বস্তির বিষয়-আমাদের দেশে গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, যা অনেক দেশেই নেই। তবে এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে আগে যেখানে প্রতিদিন উৎপাদন হতো ১ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, সেখানে এখন হচ্ছে মাত্র ৮৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। জানা যায়, ৭০টি কূপের বেশির ভাগেরই উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে।
এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থায় দেশীয় গ্যাসের জোগান বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাপেক্সের মাধ্যমে পুরোনো কূপগুলো আবার ওয়ার্কওভার তথা পুনর্খনন করে গ্যাসের জোগান বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া ভোলার অতিরিক্ত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনার কথাও ভাবতে হবে।
অভিযোগ আছে, পেট্রোবাংলা এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে না। অথচ রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের একটি কূপ থেকেই ১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানেও নেই কোনো অগ্রগতি। বস্তুত দীর্ঘদিন ধরে দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কোনো কাজ হয়নি কিংবা বলা যায়, অনুসন্ধানের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বঙ্গোপসাগরের দুটি অংশ চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমটি হলো গভীর সমুদ্র বা অফশোর। সমুদ্রের এ অংশকে ১৫টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো অগভীর সমুদ্র বা অনশোর। এ অংশের ১১টি ব্লক মিলে মোট ২৬টি ব্লক রয়েছে, যেখানে গ্যাস অনুসন্ধান করার কথা। কিন্তু এসব ব্লকের মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে না থাকার কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত হলো, জ্বালানিতে আমদানিনির্ভরতার কারণে দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় দেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ অকার্যকর রয়েছে। গত ১০ বছরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দেশি-বিদেশি কোনো কোম্পানিই আগ্রহ দেখায়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্সও এ কাজে দক্ষতা দেখাতে পারেনি। গ্যাস ব্যবস্থাপনার একটি বড় অংশ নিয়োজিত পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে; নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের আগ্রহ দেখা যায়নি। ফলে অতি আমদানিনির্ভরতার কারণে দেশের জ্বালানি খাত এখন ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
গ্যাসের অপচয়ও একটি বড় সমস্যা। জানা যায়, গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, অবৈধ সংযোগ, লিকেজ প্রভৃতি কারণে সব মিলে বছরে প্রায় ৬৫ কোটি ঘনমিটার গ্যাস অপচয় হয়। ঘাটতি মেটাতে হয় এলএনজি আমদানির মাধ্যমে। অথচ অপচয় বন্ধ করা গেলে বছরে বিপুল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হবে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের পাশাপাশি এদিকেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া দরকার বলে মনে করি আমরা।