স্টাফ রিপোর্টার: ১৭টি শর্তে (মঙ্গলবার) ১৩ সেপ্টম্বর থেকে শুরু হয়েছে যশোরের চৌগাছায় ঐতিহ্যবাহী বলুহ মেলা। চলবে ১০ দিন। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

সোমবার রাতে যশোর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে দেয়া এক অনুমতিপত্রে এসব শর্তের কথা বলা হয়।

চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা মেলার অনুমতির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইউপি সদস্য মনিরজ্জামান মিলন জানান, ঐতিহ্যবাহী বলুহ মেলা কেবল মাত্র এ জনপদের মানুষের মেলা নয়। দেশ ও দেশের বাইরে এ মেলার ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার এ মেলা শুরু হয়। মেলা শুরুর মাস খানেক আগে থেকে বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেন। কোনো রকম প্রচার বা মাইকিং ছাড়াই সাত থেকে আট দিন আগে থেকে মেলা শুরু হয়ে যায়। চলে ১৫ থেকে ২০ দিন। বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনার কারণে গত দু’বছর মেলা বসেনি। এ বছর জাঁকজমক পূর্ণভাবে মেলা বসবে বলে এলাকাবাসির প্রত্যাশা।

তিনি আরো বলেন, উপজেলার বুকচিরে বয়ে চলা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদের তীরে নারায়নপুর ইউনিয়নের হাজরাখানা গ্রামে এ এলাকার বিখ্যাত পীর বলু দেওয়ানের মাজার শরীফকে ঘিরে বসে এ মেলা। হাজরাখানা গ্রামে নদের পশ্চিম তীরে উঁচু ঢিবিতে অবস্থিত এ অঞ্চলের বিখ্যাত পীর বলুহ দেওয়ান (র.)-এর রওজা শরীফ।

ফরিদপুর জেলা থেকে পীরের রওজা শরীফে আসা লুৎফর রহমান জানান, কোনো প্রচার প্রচারণা ছাড়াই ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার এলেই আমরা ভক্তরা বলুর রওজা শরীফে চলে আসি। যুগ যুগ ধরে এখানে ওরশের পাশাপাশি চলে বলুর মেলা।

ভাদ্র মাসের ১৫ দিন থাকতে এলাকার মেয়ে জামাইরা বাবার বাড়িতে আসতে শুরু করে। বয়ে চলে আনন্দের ফুয়ারা। উপজেলা জুড়ে শুরু হয় মেলার আনন্দ। মেলায় বসে হরেক রকমের দোকান তার মধ্যে কাঠের তৈরি ফার্ণিচার, অটোবি, স্টীল ও শিশুদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা চোখে পড়ার মতো।

হাজরাখানা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মজিবর রহমান বলেন, পীর বলুহ কেবল মাত্র আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য নয় তিনি আমাদের দেশের গৌরব। বংশ পরস্পরায় যুগ যুগ ধরে এই পীরের রওজা শরীফকে ঘিরে ওরশ ও মেলা চলছে। নিদিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় রওজা থেকে শুরু করে গ্রামের মধ্যে পড়ে থাকা মালিকানা জমি ও রাস্তার দু’ধারে বসে মেলার দোকান পাশারি।

একই গ্রামের গোলাম হোসেন বলেন, ‘পীরের রওজাকে ঘিরে ওরশ ও মেলা বসে। এই মেলার পরিচিতি দেশের গণ্ডিপেরিয়ে বিদেশেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। স্থানীয় কিছু মানুষের কারণে গেল বছর মেলাতে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। তবে এ বছর যেন কোনো ধরনের সমস্যার সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি।’

পীর বলুহ দেওয়ান (র.) সম্পর্কে এলাকায় ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। বয়ষ্কদের থেকে জানা যায়, পীর বলুহ দেওয়ান (র.)-এর জন্ম সাল বা তারিখ কারো জানা নেই। তবে তার জন্ম ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড় ধোপাদি গ্রামে, তার বাবার নাম ছুটি বিশ্বাস। দারিদ্রতার সংসারে জন্ম নেয়া বলুহ খুব ছোট বেলায় হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে চলে আসেন। বলুহর মামারাও গরীব ছিলেন। তাই বলুহ মামার বাড়িতে থেকে অন্যের বাড়িতে ও ক্ষেত খামারে কাজ করতেন।

একদিন বাড়িওয়ালা বলুহকে বেদন বিলের মাঠে গরু চরাতে বলেন, বলুহ গরু মাঠে নিয়ে অন্যের ফসলের ক্ষেতে ছেড়ে গাছের নিচে বিশ্রাম করছিলো। ক্ষেত মালিক এসে গরুগুলো খোয়াড়ে নেয়ার জন্য রওনা হয়। বলুহ তখন গরুগুলো বক বানিয়ে গাছের উপর বসিয়ে রাখেন। একদিন খেজুরের গুড় জ্বালাতে বললে তিনি জলন্ত চুলায় খড়ি না দিয়ে নিজের একটি পা ঢুকিয়ে দেন।

আরো জানা যায়, তাকে সরিষা মাড়ায় করতে বললে সরিষার গাদায় আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেন। পরে তাকে বকা-ঝকা করলে তিনি ছাই বাতাসে উড়িয়ে সরিষা বের করে দেন। এ ধরনের অসংখ্য অলৌকিক কিংবদন্তী রয়েছে তাকে ঘিরে। যে কারণে তিনি পীর উপাধি পান। তার মৃত্যুর পর হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাড়ে যুগ যুগ ধরে বলুহর রওজাকে ঘিরে বসে মেলা, যার নামকরণ করা হয় বলুহ মেলা।

এ ছাড়া বলুহর জন্মস্থান ঝিনাইদহের ধোপাদি গ্রামে রয়েছে তার একটি মাজার ও চৌগাছা পৌর এলাকার বেলে মাঠ গ্রামে তার আরো একটি মাজার রয়েছে। প্রতি বছর এই দু’মাজারেও মেলা বসে হয় ওরশ।

বলুহ মেলা বিষয়ে পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজরাখানার ইউপি চেয়াম্যান শাহিনুর রহমান শাহিন বলেন, ১৭টি শর্ত সাপেক্ষে প্রশাসনের পক্ষ হতে মেলার অনুমতি দেয়া হয়েছে। চলবে ১০ দিন। এ বছর মেলায় কোনো ধরনের অশ্লীলতা আমরা হতে দেব না। গ্রামসহ এলাকার সবাই মেলার অশ্লীলতা প্রতিহত করতে একত্র হয়েছি। এছাড়া মেলায় আইন-শৃঙ্খলা ঠিক রাখতে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে