খোলা জানালা ডেস্ক : ৩৬ শে জুলাই রচনা হয়েছিলো গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে; অথচ গত সাত মাসে যেভাবে দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে আশাহত এই গণ-অভ্যুত্থানে সরসরি অংশগ্রহণ করা এবং নৈতিকভাবে সমর্থন করা অগণিত মানুষ৷
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ২৪’এর জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এটা বিশাল কিছু; শেখ হাসিনাকে তাড়ানো মানে শুধু একজন স্বৈরাচারকেই গদি ছাড়া করা না; একটা মাফিয়া পরিবারতন্ত্রের কবর রচনা করা; একইসাথে তার প্রভু ভারত, ইজরাইলকে মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন; ‘৭১ পরবর্তী দিল্লীর দাসত্বের অবসান, বাঙালি জাতীয়তাবাদের আড়ালে হিন্দুত্ববাদী হেজিমনির মূলোৎপাটন। যদিও এই ক্ষেত্রটা তৈরি করতে ঝরে গেছে প্রায় ২০০০ (দুই হাজার) তাজা প্রাণ!
হাজারও শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে এই গণ-অভ্যুত্থানের নায়কদের উচিত ছিলো বিপ্লবী সরকারের পথে হাঁটা, কিন্তু এই বিপ্লবীদের কোথায় যেন ভয়, দ্বিধা, খেদ তৈরি হলো! যদিও এর দায় শুধু বিপ্লবীদের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার না; বরং, বিদ্যমান রাজনৈতিক দল গুলো; বিশেষত, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের। তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনার বসানো প্রেসিডেন্ট চুপ্পুকে সরাতে বাঁধা দিলো। সংবিধান বাতিলের আলাপে ভেটো দিল; জুলাই প্রোক্লেমেশনে অনাস্থা জানালো; ইনটেরিম সরকারের প্রতি চুড়ান্ত রকমের অসহযোগিতা জারি রাখলো। সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণা, রাষ্ট্রের নতুন সংবিধান প্রনোয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের আলাপে নাখোশ হলো। প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং জুলাইয়ে সংঘটিত আওয়ামীলীগের গণহত্যার বিচারের আগেই নির্বাচন নির্বাচন করতে হণ্যে হয়ে গেলো।
এই মুহুর্তে সেকেন্ড রিপাবলিক কেন দরকার?
চব্বিশের জুলাই’য়ে রাজপথে লড়াই করা বিপ্লবীরা নেমেছিলো ফ্যাসিবাদ, অর্থপাচার, বৈষম্য, নৈরাজ্য, দূর্নীতি, আর ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেয়ে প্রকৃতপক্ষে রিপাবলিক হয়ে উঠতে; অর্থাৎ পুর্নাঙ্গ নাগরিক হয়ে উঠতে। কিন্তু আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পরিবারতন্ত্র এবং লেজুরবৃত্তিক রাজনৈতিক চর্চা আবারও প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটা পাড়া মহল্লায়, হাটবাজারে, মফস্বলে, বাজার এবং শহরগুলোতে, প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটিতে, টেম্পুস্ট্যান্ড থেকে জলমহল; ভিসি, ডিসি, এসপি, ইউএনও সবখানে বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের তদবীরে চলছে; শুধুমাত্র ফ্যাসিস্ট শাসিত আমলের মানুষগুলো চেঞ্জ হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়নি।
সিস্টেম পরিবর্তন হবে, এই আশায় যারা রাস্তায় নামলো, তাদের প্রাপ্তিটা কোথায়? জুলাইয়ের জন-আকাঙ্খাগুলো আমরা কতটুকু বাস্তবায়িত হতে দেখেছি? তাই জুলাইয়ের জন-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্য সবার আগে রক্তাক্ত জুলাইয়ে রাজপথের যোদ্ধাদের ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা বিপ্লব না গণ-অভ্যুত্থান; এই তর্কে না গিয়ে বরং বিপ্লবের জন্য লড়াইটা জারি রাখা জরুরি।
বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো ‘নির্বাচন নির্বাচন’ করে দেশের মধ্যে এন্ট্রপি বাড়াচ্ছে। অথচ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে, ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ বেশি জরুরি।
গণপরিষদ নির্বাচন কি?
গণিপরিষদ নির্বাচন হল সংবিধান রচনা করার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন, যেখানে সকল শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব থাকবে; সকল শ্রেনীর ব্যপ্তি হতে পারে, মালিক থেকে শ্রমিক, শিল্পপতি থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ছাত্র থেকে প্রফেসর, সকল রাজনৈতিক পার্টি, জাতি, ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধিত্ব। সেই ঐতিহাসিক সভায় সবার মতামতের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করা হবে; রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক যেন মনে করে এই সংবিধানে আমার প্রতিনিধিত্ব আছে৷ সংবিধান রচিত হবার পর সেই গণপরিষদ ভেঙে যাবে।
এখন, প্রশ্ন হলো, এই গণপরিষদ নির্বাচন ও সেকেন্ড রিপাবলিক এর ঘোষণা দিতে আপত্তি কাদের?
উত্তর সোজা, যারা এই বিদ্যমান সংবিধানের ফাঁকফোকড়ের ভেতর দিয়ে ফ্যাসিবাদ গড়ে তুলেছিলো, এবং যারা এই ফ্যাসিজম আবার কায়েম করতে চায়, আপত্তি মূলত তাদেরই!
চুপ্পুকে সরাতে তাদের আপত্তি, সেনাপ্রধানকে সরাতে তাদের আপত্তি, আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে তাদের আপত্তি; সংস্কারের প্রশ্নে তাদের আপত্তি; কারন নির্বাচনের আগেই তো প্রায় সবকিছু দখল করা শেষ! তারা সর্বময় ক্ষমতা চায়, পুলিশ, প্রশাসন, বিচারবিভাগ সব নিজেদের মত করে নিতে চায়; সবাই এক একটা হাসিনা হতে চায়৷
তবে আমরা আর কাউকেই হাসিনা হতে দিবো না৷
লেখক : রাশেদ খান
আহ্বায়ক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যশোর জেলা ।
Leave a Reply