দূর্জয় আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ঠিক এক বছর আগে ২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট বাতিল করা হয়েছিল ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা।
পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুরোপুরি মুছে ফেলে একে লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
এর পর দীর্ঘদিন লকডাউন করে সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তেমনই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন – সবকিছুই ।
বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ সরিয়ে নেওয়ার সময়ে কাশ্মীরের যেসব উন্নয়নের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, তা কতটা কার্যকর হল? একবছরে কি কোন পরিবর্তন হয়েছে কাশ্মীরের?
কিছুদিন আগে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনের প্রধান – কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলটির লেফটেনান্ট গর্ভনর জি সি মুর্মু একটি বৈঠক করেছিলেন প্রশাসনের শীর্ষ আমলাদের নিয়ে।
সেটির ছবি প্রকাশিত হতেই কাশ্মীরের মানুষদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।
কারোই চোখ এড়ায়নি যে বৈঠকে হাজির ১৯ জনের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন কাশ্মীরী মুসলমান ।
সামাজিক মাধ্যমে চর্চা শুরু হয়, কাশ্মীরের ৯৭ শতাংশ মানুষ যেখানে মুসলিম, সেখানকার প্রশাসনের শীর্ষে কেন মাত্র একজন কাশ্মীরি মুসলিম?
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ওই ছবিটি দেখে, যে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কি তাহলে কাশ্মীরে কাশ্মীরিরাই ব্রাত্য হয়ে গেলেন!
শ্রীনগরে বিবিসি-র সহকর্মী রিয়াজ মাসরুর বলছিলেন, প্রশাসন যদি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেই থাকত একবছরে, তাহলে তো ৪ আর ৫ই অগাস্ট বিক্ষোভের ভয়ে কারফিউ জারি করতে হত না।
মি. মাসরুর বলছিলেন, “বিজেপি তো বলেছিল ৫ তারিখ থেকে ১৫ তারিখ অবধি তারা ধুমধাম করে উদযাপন করবে দিনটা। কিন্তু প্রশাসনই আজ আর আগামীকাল কারফিউ জারি করেছে।”
“তাদের এই সিদ্ধান্তেই তো বোঝা যাচ্ছে যে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে নি সরকার। সেটা যদি হত, তাহলে তো আজ রাস্তাঘাট শুনশান থাকত না। বিজেপির সদর দপ্তরে ধুমধাম হত!”
রিয়াজ মাসরুর বলছিলেন, মানুষ যে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় নি, এটা প্রশাসনও বুঝেছে।
কাশ্মীরের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ তুলে নেওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট যেমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তেমনই বন্ধ থেকেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসা বাণিজ্য।
কাশ্মীরিদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল যে পর্যটন, তাও বন্ধ। কাশ্মীরের মানুষ লকডাউন প্রত্যক্ষ করেছেন – গত বছরের ৫ অগাস্ট থেকেই –ভারতজুড়ে কোভিড থেকে রক্ষার জন্য লকডাউনের অনেক আগে থেকেই।
মার্চ মাসে করোনা থেকে রক্ষায় লকডাউন শুরুর ঠিক আগেই পুলওয়ামায় গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছিলেন কলকাতার একটি কলেজে পড়াশোনা করেন এমন এক কাশ্মীরি ছাত্র।
নিজের নাম প্রকাশ করতে চাইছিলেন না তিনি।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান বিবাদ চলছে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে তার কাছে বিবিসির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় একবছর পরে কাশ্মীরে কী পরিবর্তন দেখছেন তিনি?
ওই ছাত্রটির কথায়, ভালর দিকে কোনও পরিবর্তন তার চোখেই পড়ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য তো ভীষণভাবে মার খেয়েইছে একবছরে, কিন্তু সবথেকে ক্ষতি বোধহয় হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের।
“গত একবছরে খুব বেশি হলে ৭ দিন ঠিক মতো স্কুল কলেজে ক্লাস হয়েছে — তারপরেই তো আবার করোনার জন্য লকডাউন শুরু হয়ে গেল। এখনও ৩ জি, ৪ জি ইন্টারনেট বন্ধ – শুধু ২ জি চলছে। ছাত্রছাত্রীরা তাই অনলাইন ক্লাসও ঠিক মতো করতে পারছে না।”
“সবার চোখেমুখেই একটা উদ্বেগের ছাপ.. কাল কী হবে, কেউ জানে না.. যে নতুন কাশ্মীরের কথা ভারত সরকার বলেছিল, তার তো দেখা পাওয়াই যাচ্ছে না, উল্টে এই একটা বছরের মধ্যে কাশ্মীরকে বহু বছর পিছিয়ে দেওয়া হল” – বলছিলেন কলকাতায় পড়াশোনা করা ওই কাশ্মীরি ছাত্র।
ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন করোনার লকডাউনের জন্য এখন বন্ধ, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ এক বছর ধরেই।
ওমর আবদুল্লাসহ কয়েকজন নেতাকে মুক্তি দেওয়া হলেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিসহ বহু নেতা-নেত্রী এখনও গৃহবন্দী।
কাশ্মীর টাইমস পত্রিকার সম্পাদিকা অনুরাধা ভাসিনে বলছিলেন, যেভাবে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের ভাবনারই বিরোধী।
মিজ ভাসিনের কথায়, যেভাবে গত একবছর ধরে নানা নীতি নেওয়া হয়েছে, তাতে কোনও ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ডেরই আর জায়গা নেই।
“রাজনীতি তো আর শুধুই ভোটের প্রচার নয়.. কিন্তু যেভাবে নির্দিষ্ট রেখা টেনে দিয়ে বলে দেওয়া হচ্ছে যে এই বিষয়ে কথা বলা যাবে না, ওই বিষয়ে নিয়ে কথা বলা যাবে — এটা গণতন্ত্রের মূলভাবনাটাকেই তো অস্বীকার করা হচ্ছে।”
অনুরাধা ভাসিন বলছিলেন, যেটুকু রাজনৈতিক কথাবার্তা হচ্ছে, তা সাধারণ মানুষের মনের কথা নয়।
কাশ্মীরে গত একবছরে কী কী পরিবর্তন হয়েছে, কীভাবে বদলেছে সেখানকার মানুষের জীবন — সে প্রসঙ্গে বিবিসি-র সংবাদদাতা রিয়াজ মাসরুর বলছেন, পরিবর্তন তো হয় তখনই, যখন জীবন চলতে থাকে, কাজকর্ম হতে থাকে।
কিন্তু কাশ্মীরে তো জীবন হঠাৎ করেই গত বছরের ৫ অগাস্ট সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছে… যেন সময় থেমে গেছে সেদিনই।”
আরো পড়ুন: কাশ্মীরে বিশেষ মর্যাদা হরণের এক বছর পর আবার কারফিউ