1. admin@channeldurjoy.com : admin : Salahuddin Sagor
  2. news.channeldurjoy@gmail.com : Editor :
আন্দোলনে বোনেরা ঢাল হলেও শ্রদ্ধাভরে নাম উচ্চারিত হয় না। - চ্যানেল দুর্জয়

আন্দোলনে বোনেরা ঢাল হলেও শ্রদ্ধাভরে নাম উচ্চারিত হয় না।

  • প্রকাশিত : সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০২০

শারমিন সুলতানা লিলি।। ২০০৭ সালের ২০ থেকে ২৩ আগস্টের আন্দোলনের বীজ রোপণ হয়েছিল ১৬ জুলাই। ১৬ জুলাই এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের পটভূমি রচিত হয়। সেদিন খুব ভোরে গণতন্ত্রের মানসকন্যা, জাতির জনকের কন্যাকে তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকার গ্রেপ্তার করে। আগস্ট আন্দোলনের পেছনে যে শক্তি কাজ করেছিল, তা একমাত্র ছিল নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা।

২০০৭ সালের ২০ আগস্ট বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনাসদস্যদের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষের জের ধরে এ আন্দোলনের সূত্রপাত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে ফখরুদ্দীন-মইনের শাসনামলে দেশব্যাপী বসানো হয় নির্যাতন কেন্দ্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে ফুটবল খেলা চলছিল। ওই খেলাকে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। খেলার মাঠেই শিক্ষার্থীদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।

সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতে দেখি, কিন্তু তখনো ঘটনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাইনি। আস্তে আস্তে যখন পুরো ঘটনা জানতে পারি, তৎক্ষণাৎ আমরা সিদ্ধান্ত নিই (হাসি আপা, ঊর্মি আপা ও আমি) মিছিল করার। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। টিভিরুমে বেশ কয়েকজন আপু ছিলেন, তাঁদের ঘটনার বিবরণ দিই এবং আমাদের সঙ্গে মিছিলে আনতে সমর্থ হই। এ ঘটনা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে গেলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা।

সে সময় আমাদের এই আন্দোলনের ওপর আক্রমণ চালায় পুলিশ। নীলক্ষেত, টিএসসি, কার্জন হল এলাকাসহ ক্যাম্পাস পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেটে আহত হয় আমাদের শত শত ভাইবোন। টিয়ার শেলের ধোঁয়া থেকে বাঁচতে আমরা হল থেকে পত্রিকা নিয়ে তাতে আগুন দিই। আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্র থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প সরানো হয়।

রাজু ভাস্কর্যের সামনে আন্দোলনরত কিছু ছাত্রের ওপর যখন হামলা হয়, তখন আমরা রোকেয়া হলের গেট জোর করে খুলেছিলাম এবং প্রতিরোধ করেছিলাম।

আমরা ধর্মঘটের ডাক দিই, কোথাও কোনো ক্লাস-পরীক্ষা চলবে না। সারা ক্যাম্প্যাসে আমরা টহল দিই। আমি, হাসি আপা, ঊর্মি আপা, আরো কিছু হলের মেয়ে ছিল। আমরা রোকেয়া হলের সামনে অবস্থান নিচ্ছিলাম। এমন সময় অপর্ণা দিদি ফোন দিয়ে বলল, ‘লিলি মইনুল ইসলামের কুশপুত্তলিকা বানা, দাহ করতে হবে।’ দৌড়ে হলের ভেতরে গেলাম। দুটি বাঁশ জোগাড় করে বেঁধে তাতে মাথায় কিছু পেপার দলা করে পেঁচিয়ে দাদুদের কাছ থেকে একটা শার্ট চেয়ে নিলাম আর সেই কুশপুত্তলিকা দাহ করলাম। সে মূহূর্তে আমাদের সঙ্গে অনেকে এসে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কেন্দ্র তখন আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

আমরাই অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, শাহবাগ, চারুকলা, নাট্যকলা, পলাশীর মোড়, নীলক্ষেত মোড়, উদয়ন স্কুল, ফুলার রোড, মল চত্বর স্লোগান-মিছিলে প্রকম্পিত করেছিলাম।

আমাদের এই আন্দোলন গোটা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে। রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক আনোয়ার। পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভাগীয় শহরগুলোতে কারফিউ জারি করে। ওই দিন সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাবির আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ২৩ আগস্ট রাতে আটক করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদকে। তাঁদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজানা স্থানে। পরে ঢাবির আরো দুই শিক্ষকসহ পাঁচ ছাত্রনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

মনে পড়ে সুজনের কথা। ৯ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে সুজনকে। একটানা তিন দিন চোখ বেঁধে চালানো হয় নির্যাতন। শুধু খাবার দেওয়ার সময় চোখ খুলে দিত আর একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করত, একে চেনে কি না। সুজন তখন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। আমাকে চেনার কথা নয়। ও আমাকে চিনতও না। কিন্তু আমার ছবি দেখিয়ে ওর ওপর চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। ওর চোখের নিচে কালো হয়ে যাওয়া জায়গাটা দেখাল, বলতে বলতে সুজনের গলা ধরে আসে।

এখনো মনে পড়ে চারদিকে বুলেট ও টিয়ার শেলের বারুদের গন্ধ। মনে পড়ে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা। এমনই এক পরিবেশে ২০০৭ সালের ২০ থেকে ২৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় হামলা হয়। হামলা, মামলা, হুলিয়া নিয়ে আমাদের অনেককে আত্মগোপন করতে হয়েছিল।

ঘটনার দীর্ঘ ৬৬ দিন পর খুলে দেওয়া হয় ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো নির্যাতনবিরোধী ব্যানারে এবং পরে আরো দুটি ব্যানারে আন্দোলন হয়। আমাদের সেই আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক মুক্তির আন্দোলনে গতি সঞ্চার করেছিল। ধীরে ধীরে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তি আন্দোলনের কাছে হার মানে সরকার। ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তি নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনে যেন গতির সঞ্চার করে। আমাদের আন্দোলনের ফলে সারা বাংলাদেশ তখন ফুঁসে ওঠে নেত্রীর (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মুক্তির দাবিতে। তীব্র প্রতিরোধের মুখে ২০০৮ সালের ১১ জুন নেত্রীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার।

এক-এগারোর প্রেক্ষাপট বা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকে নিজেকে জাহির করে, তবে ইতিহাস লিখতে হয় নির্মোহভাবে। কিন্তু যখনই কোনো বিশেষ দিন আসে, সবাই যার যার মতো করে ইতিহাস লেখে। এ কথা কোথাও কেউ বলে না, রোকেয়া হলের নেতৃত্বে আমরা তিন-চারজন (আমি, হাসি আর ঊর্মি আপা) উদ্যোগ নিয়ে ১৫-২০ জন মিলে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ্যে মিডিয়া ডেকে আপার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছিলাম। কিন্তু যাঁদের রক্ত, ঘাম আর ত্যাগে সেই ইতিহাস জন্ম নেয়, তাঁরা সব সময় উপেক্ষিতই থেকে যান।

তখন রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ছিলেন তাজমেরী ম্যাডাম। তাঁর সঙ্গে একরকম যুদ্ধ করে আপার (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মুক্তির দাবিতে প্রথম ব্যানারটা রোকেয়া হলের গেটে আমরা টাঙিয়েছিলাম। রোকেয়া হলের ছাত্রীদের ব্যানারে আমরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেছিলাম। ১৫ আগস্টে শত বাধার মুখে হলে মিলাদ পড়িয়েছিলাম আমরা, যেখানে হলের দাদুরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন আমাদের। রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম ব্যানার-ফেস্টুন হাতে সরকারের বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য, দুজনের নাম নিতে চাই; সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি টিপু ভাই এবং সাধারণ সম্পাদক বাদশা ভাইয়ের নাম, যাঁরা সব সময় এই আন্দোলনে আমাদের সহযোগিতা করেছিলেন।

কেউ মনে রাখেনি

এত এত সভা-সেমিনার হয়। আমার ভাইয়েরা বক্তব্য দেয়, আমার সহযোদ্ধারা বক্তব্য দেয়; কিন্তু এই অধম বোনদের কথা কেউ কোথাও উল্লেখ করে না। এই আন্দোলন ইতিহাসের পাতায় রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পালন করে কালো দিবস, তার পরও কেউ মনে রাখেনি। এ আন্দোলনই নেত্রীর মুক্তির পথকে সহজ করেছে; এ আন্দোলনই নেত্রীর মুক্তির আন্দোলনের পটভূমি রচনা করেছিল; এ আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা নেত্রীর মুক্তি আন্দোলনের জোরালো ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছিলাম; এ আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা গোটা জাতিকে, ছাত্রসমাজকে জাগ্রত করতে পেরেছিলাম; এ আন্দোলনের সূত্র ধরেই নেত্রীর মুক্তির পরিবেশ তৈরি করেছিলাম, যার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন অবৈধ সরকার বাধ্য হয়েছিল নেত্রীকে মুক্তি দিতে। তার পরও কেউ মনে রাখেনি। আন্দোলন-সংগ্রামে বোনেরা শুধু ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু কখনো শ্রদ্ধাভরে তাদের নাম উচ্চারিত হয় না।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগ; সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ; সাবেক সভাপতি, রোকেয়া হল, ঢাবি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

এই বিভাগের আরো সংবাদ

আজকের দিন-তারিখ

  • শুক্রবার (সকাল ৮:০৮)
  • ২৯শে মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১৯শে রমজান ১৪৪৫ হিজরি
  • ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ (বসন্তকাল)

এই মুহুর্তে সরাসরি সংযুক্ত আছেন

Live visitors
167
3176453
Total Visitors

©All rights reserved © 2020 Channel Durjoyচ্যানেল দুর্জয় মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত একটি অনলাইন স্বাধীন গণমাধ্যাম, চ্যানেল দুর্জয়ের প্রতিনিধির নিকট থেকে শুধু তার প্রেরিত সংবাদ গ্রহণ করা হয়, সংশ্লিষ্ঠ প্রতিনিধি যদি সমাজ/রাষ্ট্রবিরোধী কোন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তাঁর দ্বায় দুর্জয় কর্তৃপক্ষ বহণ করবেনা
Customized BY NewsTheme