উজ্জ্বল রায়ঃ
মাকে আমরা সাধারণত খুব শান্ত, স্মিতহাস্য ভাবেই দেখেছি। কোনোদিন অসন্তুষ্ট বা রাগতে দেখিনি, কিন্তু আমার জীবনে এমন একটি অভিজ্ঞতাই হয়েছিল যেখানে মাকে আমি এই প্রথমবার অসন্তুষ্ট ও কড়াভাষায় কথা বলতে শুনেছিলাম। চৈত্রের শেষদিকে একদিন সকালে মায়ের চরণদর্শন করতে উদ্বোধনে গেছি। মা তখন উপরে ঠাকুর ঘরের পাশের ঘরটিতে অন্যকিছু সম্ভ্রান্তকূল ভক্তমহিলার সঙ্গে বসেছিলেন এবং তাঁদের নানারকম প্রশ্নের উওর দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, “বৌমা এসো, আজ তোমার কথাই ভাবছিলাম, অনেকদিন হলো বৌমা আসে না। তা বেশ করেছ আজ এসে। প্রসাদ পেয়ে তবে যাবে।” আমি মাকে প্রণাম করে কিছুটা দূরে গিয়ে বসলাম ও তাঁদের কথোপকথন শুনতে লাগলাম। ওই ভক্তমহিলাদের মধ্যে একজন মাকে বলছেন, “মা একটা উপায় করে দিন! স্বামীর ব্যবসার যাতে উন্নতি হয়। ওঁনার অনেক শত্রু, সেই শত্রু যাতে নাশ হয়। আপনি চাইলে তো সবই পারেন। এরজন্যে যা করতে হয় আমি করব।” তাঁর কথাশুনে মায়ের মুখাবয়ব কেমন যেন পাল্টে গেল। আগে কখনো মায়ের এইরূপ আমি দেখিনি। রুদ্রমূর্তি! মা ভক্ত মহিলাটিকে তৎক্ষণাৎ তিরস্কৃত করে বললেন, “একি হীনবুদ্ধির কথা? তুমি কি আমার কাছে সিদ্ধাই (তন্ত্র-মন্ত্র) চাইতে এসেছ? আমি কি মানুষের ক্ষতি করব? ঠাকুর সিদ্ধাই ঘৃণা করতেন। বলতেন, ‘তন্ত্র করে লোকের অসুখ সারবে, আয় উন্নতি হবে, বশ হবে এসব ভালো নয়। এতে ভগবানকে ভুলে যেতে হয়। অসুখ করলে ডাক্তার-বদ্যি রয়েছে কি করতে? আয় উন্নতির জন্যে পরিশ্রম করতে হয়। আর মানুষকে বশে করতে গেলে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসায় সব হয়।’ আর তুমি কিনা আমার কাছে সিদ্ধাই চাইতে এসেছ? ভুলেও আর কোনোদিন এসব আমার কাছে বলবে না। মানুষের কি করে ভালো হবে, তাঁর পথ তো ঠাকুর দেখিয়েই গেছেন। তাঁকে দিনান্তে একবার স্মরণ-মনন করলেই মানুষের সকল দু:খ-বিপদ দূর হয়। তার জন্যে সিদ্ধাইয়ের প্রয়োজন হয় না! আর ঠাকুরের সন্তানরা এসব হীনবুদ্ধির কথা বলবে না। এসবে কারোর মঙ্গল হয় না।”
মা যখন কথাগুলি বলছিলেন মায়ের মুখের দিকে তাকাতে ভয় করছিল, যেন সাক্ষাৎ মহামায়া রুদ্ররূপ ধারণ করেছেন। ভক্ত-মহিলাটি মায়ের এই তিরস্কার শুনে মায়ের কাছে তৎক্ষণাৎ ক্ষমা চেয়ে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিন মা, সংসারের নানা অশান্তিতে কূল পাই না, তাই কি বলতে কি বলে ফেলেছি। আমাকে দয়া করুন।” ভক্ত-মহিলার আকুতিতে তখন মায়ের মুখমণ্ডল আবার সেই আমাদের চির পরিচিত করুণাময়ী রূপে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ভক্ত-মহিলাটি বললেন, ” সংসার বিষের গাছ,এমন তো হবেই মা! কিন্তু তার জন্যে কি এমন ভাব আনতে আছে? সর্বদা জানবে ঠাকুর তোমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তিনি তোমাদের সকল বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করছেন। তাঁকে স্মরণ করলে কোনো দু:খ থাকে না। এ তাঁরই মুখের কথা।” মায়ের আশ্বাসবাণী পেয়ে ভক্ত-মহিলাটির মন শীতল হল এবং সেখানে উপস্থিত সকলেরই মন শীতল হল একইভাবে।