উজ্জ্বল রায়:দেবর্ষি নারদ মুনি কৃষ্ণকথা শ্রবণের লোভে জগতের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, কিন্তু কোথাও কৃষ্ণনামের মহিমা শুনতে পেলেন না। কৃষ্ণপ্রেমের আবেশে নারদ মুনির হর্ষ, পুলক, কম্প আদি অষ্টসাত্ত্বিক বিকারের লক্ষণগুলি প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু কলিহত জীবের কৃষ্ণবিমুখতা দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, কলির কালসর্প সকলকে দংশন করেছে। সকলেই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মাৎসর্যে আচ্ছন্ন হয়ে,
“আমি ও আমার” এই চিন্তায় বিভোর। কলিহত জীবের এই প্রকার দুর্দশা দেখে নারদ মুনি ভাবলেন, “এদের মুক্তির উপায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না; একমাত্র ভগবান কৃষ্ণ স্বয়ং অবতরণ করে যদি এদের মুক্ত করেন, তবেই কলির জীবসকল মুক্তি লাভ করতে পারে। ” তখন নারদ মুনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন, “যেভাবে হোক কৃষ্ণকে এই কলিযুগে আনতেই হবে। ভগবান ভক্তবৎসল, তিনি ভক্তের ডাকে অবশ্যই সাড়া দেবেন, সকল শাস্ত্রে সেটি প্রতিপন্ন হয়েছে।” আর ভগবান কৃষ্ণের সাথে ব্রহ্মা, শিব আদি দেবতারাও যাতে এই পৃথিবীতে আসেন, তাও তিনি প্রার্থনা করেন। এরূপ চিন্তা করে শ্রীনারদ মুনি বীণা বাজাতে বাজাতে দ্বারকার অভিমুখে চলতে লাগলেন। এদিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সত্যভামার গৃহ থেকে বিদায নিয়ে প্রভাতে রুক্মিণীদেবীর গৃহে এসেছেন তাঁকে কৃপা করার জন্য। রুক্মিণীদেবী পূর্ব থেকেই সুসজ্জিতা হয়েছিলেন। তাঁর সখীরা তাড়াতাড়ি সুবাসিত বারি এনে দিলেন, আর তা দিয়ে উত্তমরূপে শ্রীকৃষ্ণের পাদ প্রক্ষালন করতে করতে ভগবানের পাদপদ্ম হৃদয়ে ধারন করে রুক্মিণীদেবী অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। রুক্মিণীদেবীকে অকস্মাৎ ক্রন্দন করতে দেখে, ভগবান কৃষ্ণ অবাক হয়ে বলতে লাগলেন,
“কি কারণে তুমি কাঁদতে শুরু করেছ? আমি কি তোমার কোনও আদেশ অবজ্ঞা করেছি অথবা তোমার কাছে কোনও দোষ করেছি? পূর্বে তোমার সঙ্গে পরিহাস করে একবার আমি তোমার মনে দুঃখ দিয়েছিলাম, সেই কথা মনে পড়াতে কি তুমি এমন ক্রন্দন করছ? কিন্তু তোমাকে আমি যেভাবে প্রাণের চেয়ে ভালবাসি, সেভাবে আর কাউকে ভালবাসি না। তা হলে তোমার মনের কথা আমাকে দয়া করে বল, কি জন্য তোমার দুঃখ হল।
” ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট এই প্রকার উক্তি শ্রবণ করে রুক্মিণীদেবী বলতে লাগলেন, “যেখানে তুমি আমার প্রাণনাথ আর তোমার পাদপদ্মের সেবা যে লাভ করতে পারে, তার আবার কিসের দুঃখ? ব্রহ্মা, শিব সকলেই তোমার পাদপদ্মের সেবা লাভের জন্য কাতর হয়ে প্রার্থনা করে। তুমি জগতের সকলের মনের কথা জান, অথচ নিজের প্রেমার মনের কথা জান না। যদি তুমি ‘রাধার ভাব’ হৃদয়ে ধারণ করতে, তা হলে আমার মনের কথা জানতে পারতে।” রুক্মিণীদেবীর শ্রীমুখ থেকে শ্রীমতী রাধারানীর কথা শ্রবন করে কৃষ্ণ তৎক্ষণাৎ চমকিত হয়ে রুক্মিণীদেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি যা বললে, তা আবার বল, আমি ঠিক শুনতে পাইনি। তোমার কাছ থেকে আবার শোনার জন্য আমার হৃদয় ব্যাকুলিত হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে এই জগতে এমন কিছু দুর্লভ বস্তু রয়েছে, যা আমি এখনও জানি না। হে দেবী! দয়া করে তুমি আমাকে সেই কথা আর একবার শোনাও! এভাবে দ্বারকায় বসে যখন শ্রীকৃষ্ণ হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ করছিলেন, তখন রুক্মিণীদেবী করুণ স্বরে বলতে লাগলেন,
“তুমি জগতের নাথ, কোন কিছুই তোমার অগোচর নয়, অথচ তুমি আমার মনের দুঃখ জান না। আমার একমাত্র ভয় হয় যদি আমি তোমার চরণসেবার সুখ থেকে বঞ্চিত হই। কারণ তোমার পাদপদ্মে এমন অমৃত রয়েছে যে, সে আর এই জগতের কিছুই কামনা করে না। ব্রহ্মা, শিব, নারদ সকলেই তোমার পাদপদ্মের সেবার জন্য ধ্যান করছে, এমন কি বিষ্ণুর বক্ষবিলাসী লক্ষীদেবী পর্যন্ত তোমার চরণ-সেবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। অথচ তুমি তোমার পাদপদ্মের মাধুরীর মহিমা জান না। তোমার পাদপদ্মের বিরহের যে কি জ্বালা, তা একমাত্র বৃন্দাবনের শ্রীমতি রাধারানীই জানেন; তাঁর ভাগ্যের সীমা নেই। রাধার প্রেমে তুমি এখনও বাঁধা, আর তাঁর কথা শোনা মাত্রই দেখছি তোমার আঁখি অশ্র“তে ছল ছল করছে। সুতরাং তুমি রাধাকে এখনও ভুলতে পারনি। শুধু তাই নয়, তুমি দিবানিশি অন্তরে শ্রীমতী রাধার নাম জপ করছ। তাই হে প্রাণনাথ! আমি ভীত হয়ে পড়েছি, কারণ শ্রীমতী রাধারানী বৃন্দাবনে তোমার বিরহে যেভাবে দিবানিশি অশ্র“বর্ষণ করে উন্মাদের মতো প্রলাপ বকছে, আমিও হয়ত একদিন তোমার পাদপদ্মের সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারি।” রুক্মিণীদেবীর এই প্রকার হৃদয়-বিদারক বাক্য শ্রবণ করে ভগবান কৃষ্ণের অন্তর উল্লসিত হল, চক্ষু রক্তিমবর্ণ ধারণ করে জলে পূর্ণ হল এবং বলতে শুরু করলেন, “শ্রীরাধিকার প্রেমের মহিমা কি রকম, ওই প্রেমের দ্বারা শ্রীরাধা আমার যে অদ্ভুত মাধুর্য আস্বাদন করেন, সেই মাধুর্যই বা কি রকম এবং আমার মাধুর্য আস্বাদন করে শ্রীরাধা যে সুখ অনুভব করেন, সেই সুখই বা কি রকম, এই সকল আমি অবশ্যই আস্বাদন করব। এভাবেই আমি প্রেমার সুখ আস্বাদন করব।
” ঠিক সেই মুহূর্তে নারদ মুনি দ্বারকায় কৃষ্ণের সকাশে উপস্থিত হলেন। রুক্মিণীদেবী উপযুক্তভাবে অতিথি সৎকার করে নারদ মুনিকে বসতে আসন দিলেন। কৃষ্ণও নারদ মুনিকে আলিঙ্গন করে, কুশল জিজ্ঞাসা করে আগমনের হেতু জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্ত নারদ মুনি কৃষ্ণপ্রেমে বিহ্বল, চক্ষু অশ্রুতে পূর্ণ এবং কণ্ঠের স্বর গদগদ, তাই কিছু বলতে পারছিলেন না। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “নারদ! তুমি আমার প্রাণাধিক প্রিয় অথচ তোমার অন্তর দেখছি বিষণ। তুমি নিশ্চিন্তে তোমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পার।” তখন নারদ মুনি বলতে শুরু করলেন, “তুমি হচ্ছ অন্তর্যামী, সব কিছুই তুমি জান তোমার গুণকথা শ্রবণই হচ্ছে আমার আহার। সেই লোভে সারা সংসার ঘুরে বেড়ালাম অথচ কৃষ্ণনাম কোথাও শুনতে পেলাম না। সমস্ত সংসার কৃষ্ণনামে বিমুখ, এটিই আমার শোকের কারণ। লোকের নিস্তারের কোনও উপায় আমি দেখতে পাচ্ছি না। ” শ্রীকৃষ্ণ তখন নারদ মুনিকে সান্ত্বনার নিমিত্ত বলতে লাগলেন, “তুমি কি ভুলে গেলে, পার্বতী শিবের কাছ থেকে মহাপ্রসাদের কণিকা না পাওয়াতে সে শিবের সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, ‘তুমি যেমন মহাপ্রসাদের কণিকা আস্বাদন করে কৃষ্ণপ্রেমে।