1. admin@channeldurjoy.com : admin : Salahuddin Sagor
  2. news.channeldurjoy@gmail.com : Editor :
লালনপ্রেমে ফ্রান্স ছেড়ে দীঘিরপাড়ে দেবোরা - চ্যানেল দুর্জয়
শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন

লালনপ্রেমে ফ্রান্স ছেড়ে দীঘিরপাড়ে দেবোরা

  • প্রকাশিত : শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

মাঘের বিকালে পরিপাটি হয়ে গায়ে জড়িয়েছেন ধবধবে সাদা শাড়ি আর ধূসর রঙের শাল। কুষ্টিয়া শহর থেকে অলিগলি-সড়ক ছাড়িয়ে ৫৩ কিলোমিটার পথ যাওয়ার পর দেখা মিলল ফ্রান্সের এ তরুণীর। লালন প্রেমে ডুবে ফ্রান্স ছেড়ে বাংলাদেশে এসেছেন ফরাসি নাগরিক দেবোরা জান্নাত কিউকারম্যান। প্রায় ৬ বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছেন তিনি। 
পৃথিবীর পঞ্চাশটিরও বেশি দেশ ঘুরে সবশেষ বাংলাদেশ এসে তার মনে হয়েছে এটাই ‘আপন নীড়’। বাউলসম্রাট লালন শাহকে নিয়ে যতই জেনেছেন- ততই তার প্রেমে মজেছেন। শুধু কি তাই! লালনের প্রতি প্রেমবোধ, শ্রদ্ধাভক্তি দিনকে দিন দেবোরার বেড়েছে। এসব টানে প্রিয় মাতৃভূমি ও মা সহ পরিবারের সব সদস্যকে ছেড়ে এই দেশে রয়েছেন। 
গুরু ফকির নহির শাগ’র কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে তারই ভাতিজাকে করেছেন বিয়ে। বাউলদের জীবনাচারে প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন। আর বাংলার মাটি ও বাতাসকে খুব আপন করে নিয়েছেন দেবোরা। ফরাসি টোনে স্পষ্ট বাংলা বলতে পারেন এই তরুণী। এ ভাষাতে লিখতে পড়তেও বেশ পটু। কুষ্টিয়া শহর থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপ্রু গ্রামের দীঘিরপাড়ে থাকছেন দেবোরা কিউকারম্যান। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। প্যারিসের মেয়ে দেবোরা কুকিয়েমান ও লিন্দা কুঝিয়েমাচারের মেয়ে। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের কিংসটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে স্নাতক করেছেন। তিনি একজন ভালো ট্রান্সলেটর। দেশে থাকাকালীন ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজও করতেন। দর্শনে এমএ করে ফ্রান্সে একসময় তিনি ইয়োগার শিক্ষকতাও করেছেন। 
বাংলাদেশে আসার পর বাংলার সুজলা-সুফলা মাটি তাকে খুব আপন করে নিয়েছে। প্যারিসের চিরচেনা মা, মাটি আর শতসহস্র স্মৃতিতে না মজে তিনি ডুবেছেন লালনে। বাউলদের এই জীবনাচারে খুঁজে পেয়েছেন প্রশান্তি। প্রখ্যাত বাউল ফকির নহির শাহর শিষ্য হয়ে লালন ফকিরের বলে যাওয়া আত্মিক শান্তি ও সৃষ্টি রহস্য খুঁজতে দীক্ষা নিচ্ছেন ফ্রান্সের তরুণী দেবোরা।
‘আমি কে’ এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন দেবোরা। তিনি বলেন, ‘আমি কে’- এই প্রশ্ন নিয়ে ঘুরছি। কারণ নিজের পরিচয় সবাই দেখাতে পারে কিন্তু কোনটা সত্য সেটা বেছে নিতে হয়। প্যারিসে ছেলেবেলা কাটিয়েছি, বড় হয়েছি। অনার্স পড়েছি। লন্ডন-আমেরিকাতে থেকেছি। আমি একসময় সিনেমাতে কাজ করতাম। আর সবসময় ইয়োগার মধ্যে একটা সাধনা ছিল। সাধনা এতই বেশি হয়ে যায় তখন চাকরি ত্যাগ করে ইয়োগাতে মনোযোগী হয়ে পড়ি। ওই সময়টাতে আরও বেশি করে মনে প্রশ্ন জাগে ‘কে আমি?’ আসলে প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। শেখারও শেষ নেই। তখন ফ্রান্স ছেড়ে চলে আসি ভারতে। তারপর পথ খুঁজতে খুঁজতে বাংলাদেশ, ঢাকা এরপর প্রাগপুরের এই দীঘিরপাড়ে।
বাংলাদেশে কেন এসেছিলেন- প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন, সাধুসঙ্গ দেখতে এসেছিলাম। আমার মনে হলো সাঁইজির ঘরের যারা বর্তমানে সাধু বা সাধক তাদের আধ্যাত্মিকতা জানতে আসি। অন্য ঘরে গেলে দেখা যাবে যে রাজনীতি বা অর্থনীতি হয়তো ঢুকেছে। তবে বাংলাদেশে যারা লালন সাঁইজিকে অনুসরণ করেন তাদের চর্চা এ দেশে জীবন্ত। সাধুসঙ্গ দেখতেই মূলত বাংলাদেশে আসা। তারপর মনটা একেবারে বসেই পড়ল। আর উঠতে চায়নি। এভাবেই দিন পার হচ্ছে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমে বাংলাদেশে আসেন দেবোরা। বর্তমানে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে বসবাস করেন। মাঝে মাঝে ফ্রান্সে যান। কয়েকদিন থেকে আবার চলে আসেন। নাম বদল করে হয়েছেন দেবরা জান্নাত। 
ফরাসি টানে স্পষ্ট বাংলায় বলেন, এ দেশে এসে ঘর-সংসার করা আমার জন্য এত সহজ ছিল না। আমার স্বামী আমাকে বিয়ের কথা যখন বলে ঠিক তখন কেউই আমাকে মেনে নেয়নি। আমি বিদেশ থেকে এসেছি, আমার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা এসব নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এই বাধা পার করে আসতে এই পথটা অনেক সহজ ছিল না। সত্যি বলতে কী- ভীষণ কষ্ট করেছি। তবে এখন ভালো আছি। এই বাংলার মাটি আমার খুব চেনা। এখানে যেন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পারি। আমি মনে করি, লালন সাঁইজির দর্শন যারা মানে, সাধনা করে, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে তবেই সৃষ্টির এ বিস্ময়কে জানা যাবে। ঈশ্বরকে পেতে হলে, তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে জানা দরকার সুপথের সন্ধান।
দেবোরা বললেন, আমি দর্শনের ছাত্রী। তাই বাংলাদেশে আসি গবেষণার জন্য। বাউল গুরু লালন শাহ্কে নিয়ে জানতে শুরু করি, সাধুসঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। তখন বাংলা বলতে পারতাম না। 
গুরু নহির ফকির ডেকে বললেন ‘তুমি যেহেতু এখানে থাকতে চাও তাই তোমাকে বাংলা ভাষাটা বুঝতে হবে।’ পরে অনেক চেষ্টায় শিখে নিলাম। গুরুর পরামর্শে তার আরেক শিষ্য রাজন ফকিরকে বিয়েও করে নিলাম। এরপর ২০১৭ সালের দিকে বাবা আর ভাই এদেশে আমাকে দেখতে আসেন। তারা অনেক পছন্দ করেন এখানকার প্রাণপ্রকৃতি। যাওয়ার সময় বলেন, ‘এ দেশের মানুষরা অনেক সহজ-সরল। অনেক ভালো। তুমি থাকতে চাইলে কোনে আপত্তি নেই।’
‘আমার স্বামীর মা বিয়ের আগে অনেক চিন্তায় ছিলেন। আমার ছেলে লালনবেশ ধরেছে- তার বিয়ে হবে কি করে, কে করবে বিয়ে। আর তা ছাড়া আমিও বিদেশি মেয়ে। কখনও তাকে ছেড়ে চলে যাব কিনা সেটাও ভাববেন তারা। তবে এখন তো অনেক দিন হলো আছি। প্রায় ৬ বছর পার হচ্ছে। আমাকে সবাই এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এতটুকু ভাবতে পারি।’ বাংলাদেশ ছেড়ে কখনও যেতে চান না দেবোরা জান্নাত। 
তার ভাষ্যে ‘আমি বাংলাদেশে আসার আগে পৃথিবীর অন্তত ৫০টা দেশ ঘুরেছি। তখন বারবারই মনে হয়েছে এই দেশ আমার আপন ঠিকানা। আমি যেই গুরুকে খুঁজছিলাম তাকে পেয়েছি। এখানে এসে একজন স্বামী পেয়েছি যে আমার থেকেও অনেক বেশি জ্ঞানী। আমার প্রতি যত্নবান। আমার গুরু নহির শাহকে নিয়ে কিছু বলার নেই। তিনি ভীষণ ভালো মানুষ। এ দেশে যখন প্রথম এসেছিলাম তখন মাঝেমধ্যে মনে হতো আমার চলে যেতে হবে হয়তো। এত দূরে এসে আমি কি সত্যি মানিয়ে নিতে পারব? থাকতে পারব? তবে এখন সত্যিকার অর্থে মনে হয়। এই বাংলায়, দীঘিরপাড়ে আমি থেকে যেতে চাই। মাঝেমধ্যে এখনও ফ্রান্সে যাই। বাবা-মা বেঁচে আছেন। দাদা-দাদিও বেঁচে আছেন। তাদের দেখার জন্য মাঝেমধ্যে এই যাওয়া-আসাটা থাকলেও আমি বাংলাদেশে আজীবন থাকতে চাই। এখানে যেন শেষ নিশ্বাস যেন ত্যাগ করতে পারি- সেটাই চাই।’
অবিবাহিত থাকায় দেবোরা জান্নাত প্রাগপুরের আস্তানায় বসবাসকারী নহির শাহর আরেক শিষ্য রাজনকে বিয়ে করেছেন গুরুর আদেশেই। তিনতলা এক বাসার দুই রুমটা ফ্রান্সের ঢিমেতালে সাজিয়েছেন। লাইব্রেরিতে থরে ধরে সাজিয়েছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহ। 
রাজন হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলেন, আমরা দুজনে খুবই ভালো আছি। বিয়ের পর থেকে কোনো বাধা আসেনি জানিয়ে তিনি বলেন, দেবোরা মানুষ হিসেবে অনেক ভালো। সহজ মানুষটাকে আমার প্রাগপুরের মানুষ ভীষণ ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। সাঁইজির পথমতো ছিল দর্শন। দর্শনের ছাত্রী দেবোরার এ বিষয়ে জ্ঞানও অনেক বেশি।
দৌলতপুর উপজেলার প্রাগপুরে ফকির নহির শাহর আস্তানায় তার বসবাস। ফকির নহির শাহ বলেন, ‘দেবোরার সঙ্গে পরিচয় আমার এই আস্তানা থেকেই হয়েছিল। হঠাৎ করেই একদিন ঢাকা থেকে একজনকে সঙ্গে করে তিনি এখানে চলে আসেন। আমাদের বিভিন্ন সাধুসঙ্গ দেখতে চলে আসেন। দেবোরা নিজ মুখেই তখন আমাকে জানায়, সে যেটা খুঁজছিলÑ সেটা সে এখানে এসে পেয়ে গেছে। সাঁইজির দর্শন তত্ত্বই আমার দর্শন, তাকে চিনতে জানতেই বাংলাদশে এসেছে। তাই আমাকেই তখন থেকে মনে মনে গুরু বলে মান্য করে। লালন দর্শন সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে চাইলে আমি তাকে বাংলা ভাষা শেখার কথা বলি। দেবোরা বাংলা ভাষা শেখার পর তার সঙ্গে আমার ভাব বিনিময় হয়। আমার দর্শন জ্ঞান আস্তে আস্তে তার মধ্যে দেওয়া শুরু করি এবং সে এখন লালনের দেখানো পথের অনুসারী। আমার চোখে দেবোরা বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া এক সত্ত্বা।’
ফকির নহির শাহ বাংলাদেশের একজন প্রবীণ সাধক ও লালনভক্ত। ১৯৭১ সালে দেশের প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং কুষ্টিয়ার প্রাগপুরে ‘হেম আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হন।

এই বিভাগের আরো সংবাদ

আজকের দিন-তারিখ

  • শনিবার (রাত ১০:১২)
  • ১৮ই মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
  • ১০ই জিলকদ ১৪৪৫ হিজরি
  • ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)

এই মুহুর্তে সরাসরি সংযুক্ত আছেন

Live visitors
187
3823333
Total Visitors