সালাহ্উদ্দীন সাগর : যশোরে নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পর নয় বছর বয়েসী জোনাকি খাতুনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দুপুরে খড়কী রেললাইনের পাশের একটি পুকুর থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
নিহতের স্বজনদের দাবি, পরিকল্পিতভাবে সৎ মা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে। এ ঘটনায় নিহতের সৎ মাকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ ।
নিহত কিশোরী যশোরের সীমান্তবর্তী বেনাপোল পুড়াবাড়ি এলাকার শাহিন তরফদারে মেয়ে। সে শাহিনের প্রথম স্ত্রীর সন্তান । শাহিন দ্বিতীয় বিবাহ করে দ্বিতীয় স্ত্রী নার্গিস বেগমকে নিয়ে যশোর শহরের খড়কী এলাকায় বসবাস করেন আর জোনাকি বেনাপোলে দাদির কাছে থাকতো। শাহিন শহরে ইজিবাইক চালাতো। ৭ দিন আগে বেনাপোল থেকে যশোর শহরে বাবার কাছে ঈদের কেনাকাটার জন্য আসে জোনাকি। হটাৎ করেই গতকাল সোমবার নিখোঁজ হয়ে যায় জোনাকি। তারপর ব্যাপক খোজাখুঁজি করেও কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিলো না। থানায় নিখোঁজ ডায়েরিও করেছিলেন মেয়েটির বাবা শাহিন।
মেয়েটি যশোর শহরে নতুন তাই বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন কোতয়ালী মডেল থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক। ঘটনাটি ডায়েরিভুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই থানা পুলিশের একটি টিমকে মেয়েটির সন্ধানে নামিয়ে দেন। তারা মেয়েটির ছবি নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকা,অলি গলি, রেল স্টেশন ,বাস স্টপেজ সহ সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজখবর করেও জোনাকিকে আর পায়নি কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশের সদস্যরা।
জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি পুলিশের এসআই মফিজুল ইসলামও খোঁজ শুরু করেন জোনাকির। এর আগে অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ সনাক্ত,নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান মেলানো, ক্লুলেস মার্ডারের পেছনের তথ্য ও আসামি সনাক্তে তার বিশেষ দক্ষতা থাকায় পিপিএম পদকও লাভ করেছেন তিনি। এ কারনে তার উপর বেশ ভরসা করছিলেন শাহীনের প্রতিবেশিরাও। এসআই মফিজুল তার ব্যক্তিগত ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জোনাকির ছবি আপলোড করে সন্ধান চান, এর পরপর’ই যশোর জুড়ে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনিক ভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এসআই মফিজুল ইসলাম তার নেতৃত্বাধীন বেসরকারী সেবা মূলক সংগঠন ‘সামাজিক সচেতন সংস্থা’র সেচ্ছোসেবীরাও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ খবর নিতে বলেন।
জোনাকি নিখোঁজ হবার পর , তার সন্ধানে ডিবির অফিসারের পোস্ট।(এস আই মফিজুল ইসলাম পিপিএম’ এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।)
গভীর রাত পর্যন্ত থানা ও ডিবি পুলিশের পাশাপাশি সেচ্ছাসেবীরাও ব্যাপক খোঁজাখুঁজি করেন। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস সব রাত পেরিয়ে ভোর – মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দুপুরে জোনাকির সৎ মায়ের ভাড়াবাড়ির পাশের পুকুরে ভেসে ওঠে জোনাকির ক্ষতয় ভরা নিঁথর দেহ। ফুটফুটে জোনাকির লাশ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন জোনাকির বাবা ইজিবাইক চালক শাহিন। প্রতিবেশিরাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন । সব মিলিয়ে জোনাকির এমন মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে খড়কী এলাকা জুড়ে। মাত্র ৭টি দিনে জোনাকিকে সন্তানের মত আপন করে নিয়েছিলেন জোনাকির বাবার বর্তমান আবাসস্থলের প্রতিবেশিরা।রাতভর অনুসন্ধানে থাকা ডিবি পুলিশের সেই এস আই মফিজুল ইসলাম পিপিএম আফসোস করে আরেকটি হতাশাব্যঞ্জক স্ট্যাটাসে লেখেন ‘হায় আল্লাহ মেয়েটিকে বাঁচতে দিল না’
এস আই মফিজুল ইসলাম পিপিএম’ এর ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া।
নিহত জোনাকির মেজো বোন চুমকি খাতুন (২৫) বলেন, তার ছোট বোন বেনাপোলে তাদের দাদির কাছে থাকতো এবং সেখানে একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশুনা করে। তার বাবার (শাহিন তরফদারে) অনেক সম্পত্তি আছে। সৎ মা নার্গিস বেগম সেগুলো তার নামে লিখে নিতে অনেকবার চেষ্টা চালিয়েছেন। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে পরিকল্পিতভাবে সৎ মা নার্গিস বেগম তার বোন জোনাকি খাতুনকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলে দাবি করেন চুমকি খাতুন।
প্রতিবেশিরা জানিয়েছেন, ৭ দিন আগে বেনাপোলের দাদা বাড়ি থেকে যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় বাবার বাড়িতে ঈদের কেনা কাটার জন্য আসে জোনাকি। এবারই প্রথমবার সে তাঁর সৎ মায়ের বাড়ীতে আসে। মিষ্টি চেহারা আর শিশুসুলভ আচরণে মাত্র ৭ টি দিনেই মেয়েটি সবার আপন হয়ে ওঠে। জোনাকির মৃত্যুতে কান্না করতে করতে মূর্ছাও যান অনেক প্রতিবেশি।
নিহত জোনাকির নানা সুরুজ মিয়া বলেন, জোনাকির বাবা শাহিন তার মা কহিনুরকে রেখে শহরের রেলগেট এলাকায় নার্গিস বেগম নামে আরেকজনকে বিয়ে করে। তাদের সংসারে জোনাকি ছাড়াও তার আরও দুই ভাই বোন রয়েছে। শাহিন অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করায় কোহিনুর তার তিন সন্তানকে আমার কাছে রেখে তুরস্কে পাড়ি জমায়।
জোনাকির দাদি সুববান বেগম বলেন, তার ছেলের কাছে জোনাকি ৭ দিন আগে এসেছিলো। সোমবার তিনি জানতে পারেন জোনাকির হারিয়ে গেছে। খবর পেয়েই তিনি যশোর শহরে ছেলের বাসায় চলে আসেন। তিনি জোনাকির সৎমাকে সন্দেহ করতে পারেন এমন আচারণ শাহিনের দ্বিতীয় স্ত্রী নার্গিসের মধ্যে দেখতে পাননি। নার্গিসও উৎকণ্ঠায় ছিলেন। কিন্তু পরদিন দুপুরে জোনাকির লাশ পুকুরে ভেসে উঠলেও নার্গিস স্বাভাবিক ছিলো। জোনাকি পানিতে ডুবে মারা গেছে বলে চাউর করতে থাকে নার্গিস। কিন্তু জোনাকি সাঁতার জনতো। তখন তার সন্দেহ হয় নার্গিসই জোনাকিকে হত্যা করে পানিতে ডুবে মৃত্যুর নাটক সাঁজাতে ছেয়েছিলেন। তার নাতনীকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে তিনি তার ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রী নার্গিসের বিচার দাবি করেন।
কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক এ প্রতিবেদককে জানান, গতকাল নিহত জোনাকির বাবা শাহিন তরফদার একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। মেয়েটি অচেনা শহরে প্রথম এসেছে বিবেচনায় দ্রুত তিনি থানা পুলিশের একটি টিমকে সব জায়গায় খোঁজ খবর নিতে বলেন। সম্ভাব্য সকল জায়গায় অনুসন্ধান করে তারা। কিন্তু রাতে কোথাও ওই কিশোরীকে পাওয়া যায়নি। পরদিন দুপুরে তিনি জানতে পারেন মেয়েটির লাশ তার বাবার ভাড়াবাড়ির পাশের পুকুরে পাওয়া গেছে। লাশ উত্তোলন করে দেখতে পান জোনাকির হাত পা গলা ও হাঁটুতে একাধিক ক্ষত ও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি যশোর জেনারেল হাসপাতেলর মর্চুয়ারিতে (মর্গ) প্রেরণ করা হয়েছে এবং প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিহতের সৎ মা নার্গিস বেগমকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও থানা পুলিশের পাশাপাশি জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশের একাধিক টিম মূল রহস্য উৎঘাটনে মাঠে নেমেছে এবং তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে।
Leave a Reply