ডেক্স রিপোর্ট||বিদায়ি বছরের পুরো সময় ছিল ডেঙ্গু ভাইরাসের ভয়াল থাবা। ডেঙ্গুতে এত আক্রান্ত ও মৃত্যু এর আগে দেখেনি বাংলাদেশ। এছাড়া বিশ্বের কোথাও ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, চলতি বছর সাতটি দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ তীব্রতর হয়েছে। এ তালিকায় সবার আগে রয়েছে বাংলাদেশ। রেকর্ড ডেঙ্গু সংক্রমণের এ সময়ে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে রোগীদের। হাসপাতালগুলোয় নির্ধারিত শয্যা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিতে হয়েছে সংকটাপন্ন রোগীদের। এদিকে রোগীর তুলনায় অবকাঠামো ও জনবলের সীমাবদ্ধতায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে চিকিৎসক-নার্সদের।
জনস্বাস্থ্যবিদরা যুগান্তরকে বলেন, কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের নজির আছে বিভিন্ন দেশের। ভারতের কলকাতা ও ঢাকা শহরে গত শতকের ষাটের দশকে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। কলকাতায় ভাইরাসটি এখন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে না লাগানো এবং পরিকল্পিত কর্মসূচির অভাবে ভুগছে বাংলাদেশ। বছরজুড়েই মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতাল ভর্তি হচ্ছে। অনেকে মারা যাচ্ছে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, সরকারি তথ্যের বাইরেও এবার বহু মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ, যত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, এর চার-পাঁচগুণ বাস্তবে আক্রান্ত থাকেন। যদিও পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ ব্যাপারে বরাবরই বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষিত থেকেছে। ২০১৭ ও ২০১৯ সালে ডব্লিউএইচও-এর দুজন বিশেষজ্ঞ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় নির্ধারণে স্বাস্থ্য বিভাগকে পরামর্শ দিলেও কেউ শোনেনি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
প্রকৃতির বিরূপ আচরণে সব ঋতুতেই এডিস মশার বিস্তার ঘটছে। আগে বলা হতো, ডেঙ্গু রাজধানীকেন্দ্রিক রোগ। এখন সারা দেশেই ডেঙ্গুর আক্রমণ। এদিকে মশা প্রতিকূল জলবায়ুর সঙ্গে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে শিখেছে। এমনকি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও প্রতিরোধী হয়ে উঠছে মশা। শুধু বর্ষাকাল নয়, বছরজুড়েই ভাইরাসটির সংক্রমণ থাকছে।
দেশব্যপী সংক্রমণ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর ৩ লাখ ২০ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। আক্রান্তদের ৩৫ শতাংশ ঢাকা এবং ৬৫ শতাংশ ঢাকার বাইরের। মারা গেছেন ১৭শ’র বেশি।
মাসওয়ারি আক্রান্ত-মৃত্যু : পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মারা যান ৬ জন, ফেব্র“য়ারিতে ৩, এপ্রিলে ২, মে ও জুনে ৩৪ জন। এরপরই মৃতের সংখ্যায় উল্লম্ফন ঘটে। জুলাইয়ে মারা যান ২০৪ জন। এই ঊর্ধ্বমুখী ধারায় আগস্টে ৩৪২, সেপ্টেম্বরে ৩৯৬ ও অক্টোবরে ৩৫৯ জন মারা যান। নভেম্বরের এসে এ সংখ্যা কমে ২৭৪ জন হয়। ডিসেম্বরে মারা গেছেন একশ’র কাছাকাছি।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর পাশাপাশি আক্রান্তও বেশি ছিল। জানুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৬৬, ফেব্র“য়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১ এবং এপ্রিলে ১৪৩ জন। এরপর মে থেকে বাড়তে থাকে। মেতে ১ হাজার ৩৬, জুনে ৫ হাজার ৯৫৬, জুলাইয়ে ৪৩ হাজার ৮৭৬, আগস্টে ৭১ হাজার ৯৭৬, সেপ্টেম্বরে ৭৯ হাজার ৫৯৮ (সংক্রমণ পিক বা চূড়ায় পৌঁছায়) অক্টোবরে ৬৭ হাজার ৭৬৯, নভেম্বরের ৪০ হাজার ৭১৬ এবং ডিসেম্বরে সড়ে ৮ হাজারের বেশি হাসপাতালে ভর্তি হন।
১৩ কারণে সংক্রমণ বাড়ছে : সম্প্রতি ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ডব্লিউএইচও। সংস্থাটি বাংলাদেশসহ বিশ্বে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির যে কারণগুলোর কথা উল্লেখ করেছে তা হলো, এডিস মশা ছড়িয়ে পড়ছে এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও মশার বসবাসের উপযোগী অন্যান্য কর্মকাণ্ড বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ডেঙ্গুর উপযোগী আবহাওয়া, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকা ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা। একই সঙ্গে ভাইরাসটির একাধিক ধরনের বিস্তার। সুনির্দিষ্ট লক্ষণ না থাকায় শনাক্তকরণ সমস্যা। ল্যাবরেটরি ও পরীক্ষাব্যবস্থার অপ্রতুলতা। ডেঙ্গুর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুপস্থিতি, মানুষের সচেতনতা ও আচরণ বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি। কমিউনিটিকেন্দ্রিক স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডের ঘাটতি, মশার ওপর নজরদারি ও মশা নিয়ন্ত্রণ দক্ষতার ঘাটতি, স্থায়ীভাবে অর্থায়নের ঘাটতিসহ অংশীজনদের কাজে সমন্বয়ের অভাব এবং মানুষ ও পণ্যের ব্যাপক চলাচল।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার যুগান্তরকে বলেন, বলা হয় বৃষ্টিপাত না হলে এবং তাপমাত্রা কম থাকলে এডিস মশা কমে যায়। কিন্তু এখন বৃষ্টি ও তাপমাত্রা কোনোটাই নিয়ম মেনে হচ্ছে না। দুই দশকের বেশি সময় এডিস মশায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এতে অনেকে মারা যাচ্ছেন। কিন্তু এ মশা বা অন্য পোকামাকড়বাহিত রোগ নিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তেমন কাজ হচ্ছে না। এডিসের বাইরে অন্য কোন প্রজাতি এ ভাইরাস বহন করছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না। অন্যদিকে পরিবেশের দূষণ বা পরিবর্তনের ফলে অথবা উপর্যুপরি কীটনাশক ব্যবহারে মশার শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটিয়ে আরও প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এতে সারা বছর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
নারীর পাশাপাশি শিশুমৃত্যু বেশি : ডেঙ্গুতে নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বা হয়েছেন। সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, আক্রান্তদের ৬০ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ শতাংশ নারী। তবে আক্রান্তদের মধ্যে বেশি মৃত্যু হচ্ছে নারীর। এ পর্যন্ত মারা যাওয়া ১ হাজার ৬৯৩ জনের মধ্যে নারী ৯৬৬ জন বা ৫৭ শতাংশ। আর পুরুষ ৭২৭ জন বা ৪৩ শতাংশ। নারীর চেয়ে পুরুষ কেন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, আবার পুরুষের চেয়ে নারী কেন বেশি মারা যাচ্ছেন, এর সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এ বছর ১৫ বছরের কম বয়সি ১৬৭ শিশু মারা গেছে ডেঙ্গুতে। ডেঙ্গুতে এত শিশুমৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
শয্যা সংকট, রোগীদের ভোগান্তি : বছরব্যপী ডেঙ্গু চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। বিছানা সংকট ছিল চরমে। রাজধানীতে রোগীদের ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যমতে, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৪৭১ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন মুগদা মেডিকেল হাসপাতালে।
স্যালাইন সংকট : বছরের মাঝামাঝি ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেলে স্যালাইনের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে বাজারে স্যালাইনের সংকট দেখা দেয়। এ সুযোগে নির্ধারিত দামের দ্বিগুণেরও বেশি আদায় করেন সরবরাহকারী ও ফার্মেসি ব্যবসায়িরা। ৯০ টাকার স্যালাইন বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়। এতে বিপাকে পড়েন দরিদ্র রোগীরা। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর পথ্য ডাব, কমলা, লেবু, মাল্টার মতো পথ্যের দামও বেড়ে যায়।
বাড়ে চিকিৎসাব্যয় : ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাব্যয় নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, বিদায়ি বছরে ডেঙ্গু চিকিৎসা, যাতায়াতসহ একজন রোগীর পেছনে পরিবারের ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার টাকার বেশি। এতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে পরিবারগুলোর। অনেক পরিবার তাদের মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি ব্যয় করে ফেলেছে ডেঙ্গুর চিকিৎসায়। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। একজন রোগীর খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। আর মুগদা হাসপাতালে ২৪ হাজার এবং বিএসএমএমইউতে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। তিন হাসপাতালের গড় খরচ ২৫ হাজার টাকা। গবেষণায় ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীদের গড় খরচ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, নির্ধারিত মৌসুমের বাইরে বৃষ্টিপাতসহ নানা কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। তবে এক দিনে বা এক বছরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। কয়েক বছরের চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। এখনই দেশব্যাপী সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আর সঠিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় অনেক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখা গেলেও নজরদারির অভাবে গতিপ্রকৃতি বোঝা কঠিন ছিল। ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা হওয়া উচিত। এতে করণীয় নির্ধারণ সহজ হয়। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রোগী এবং মশার সার্ভিল্যান্স করা যায়নি। স্বাস্থ্য বিভাগ ডেঙ্গুতে মৃত্যু পর্যালোচনার (ডেথ রিভিউ) তথ্য প্রকাশ করেনি। মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা হওয়া উচিত। একই সঙ্গে ডেঙ্গু রোগী, মশা, কীটনাশকের সার্ভিলেন্স করা জরুরি ছিল।
যা বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যেমন: এবার দেরিতে বর্ষা আসছে, শেষও হয়েছে দেরিতে, ঘূর্ণিঝড়সহ বেশকিছু প্রাকৃতিক দ–র্যোগও ছিল। অসময়েও বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে মশা জন্মের সহায়ক পরিবেশ পেয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনে মশার ডিম ফোটানো ও বিস্তার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। তবে আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গুর গাইডলাইন আপডেট, পকেট গাইডলাইন তৈরি, ফ্লুইড ম্যানেজম্যন্ট গাইডলাইন তৈরি ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় কাজ করছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদি একটি জাতীয় কৌশলপত্রের খসড়া তৈরি হয়েছে। এতে সারা বছর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা আছে। সিটি করপোরেশসহ বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নিয়ে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে। সব ঠিক থাকলে জানুয়ারির মধ্যে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।