?
দুর্জয় ডেস্ক।। করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ যে ধরনটি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে, সেটি ওমিক্রন। ইতোমধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার এ অতিসংক্রমণশীল ধরনটি।
.করোনার ডেল্টা ধরনের চেয়ে এটিকে কম প্রাণঘাতি বলে মনে করা হয়। কিন্তু সংক্রমনের বিচারে এটি ছাড়িয়ে গেছে ডেল্টাকেও। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ওমিক্রন এখন সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী ধরন হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে।
ওমিক্রনে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মৃদু ও মাঝারি ধরনের লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। করোনার এ ধরনের জেরে মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তির হারও কিছু কম।
কিন্তু তারপরও এটাকে হাল্কাভাবে নিতে নারাজ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এ ধরনের মাধ্যমে করোনা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখছে। যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর নতুন ধরন হিসেবে এটি যে আত্মপ্রকাশ করবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
ওমিক্রন করোনার আদি ধরনগুলো থেকে একেবারেই আলাদা। গত নভেম্বরে এটি প্রথম শনাক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। এরপরই এটি দ্রুত বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ওমিক্রন নিজ গোত্রের বাইরে সাধারণ ঠাণ্ডার ভাইরাসের থেকে কিছু জ্বীনগত বৈশিষ্ট গ্রহণ করেছে।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটি বিস্ময়কর ঘটনা না হলেও এর আগে করোনার কোনো ধরন এমনটা করেনি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে ওমিক্রন আরও বেশি মানবিক (মানবদেহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থে) হয়ে উঠেছে।
তার অর্থ হচ্ছে, করোনার অন্য ধরনগুলোর চেয়ে ওমিক্রনকে বেশি মোকাবেলা করার সামর্থ্য রাখে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, ওমিক্রন থেকে সেরে ওঠার হারও বেশি। আক্রান্তরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সেরে উঠছেন। মঙ্গলবার বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজ্ঞানীরা বলছেন, হয়তো খুব শিগগিরই করোনা মহামারি পর্ব শেষ হবে।
তাদের অনেকে মনে করেন, করোনা ভাইরাসের ধরনগুলোর ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এতে এগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী লোকজনকে টিকা দেয়ার কারণে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। এসব থেকে ধরে নেয়া যায় যে, মহামারির সময় ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
তারা বলছেন ইতোমধ্যেই কোভিড মহামারি ‘শেষ হয়ে যেতে শুরু’ করেছে। এটি যে এখন শেষ পর্যায়ে তার লক্ষণ স্পষ্ট।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- মহামারির পরে কী? জীবন কি আগের অবস্থায় ফিরে যাবে, নাকি তৈরি হবে নতুন কোনো পরিস্থিতি? ভাইরাসটি কি এই পৃথিবী থেকে একেবারেই উধাও হয়ে যাবে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো সন্দেহ নেই যে কোভিড থাকবে, কিন্তু সেটা ‘প্যান্ডেমিক’ হিসেবে নয়, থাকবে ‘এন্ডেমিক’ হিসেবে।
অর্থাৎ আমাদের সামনে কোভিড-পরবর্তী নতুন এক বিশ্ব আসন্ন যেখানে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মহামারির মতো এতো মানুষের মৃত্যু না হলেও এই অসুখ আর ১০টি সাধারণ রোগের মতোই থেকে যাবে।
যুক্তরাজ্যে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর জুলিয়ান হিসকক্স বিবিসির স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদদাতা জেমস গ্যালাহারকে বলেন, ‘বলা যায় যে এরকম পরিস্থিতিতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। বলতে পারেন মহামারি শেষ হতে শুরু করেছে। অন্ততপক্ষে যুক্তরাজ্যে। আমার মনে হয় ২০২২ সালে আমাদের জীবন মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।’
করোনা ভাইরাসের দুর্বল ভ্যারিয়েন্ট- ওমিক্রনই তার অন্যতম লক্ষণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এ ভ্যারিয়েন্ট যত বেশি ছড়াবে ভাইরাসটি ততোই দুর্বল হয়ে পড়বে। এর মধ্য দিয়েই অবসান ঘটবে এ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্য সঙ্কটের।
কিন্তু বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর মনে করেন না যে খুব শিগগিরই বর্তমান মহামারির অবসান হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘গত একশ বছরে শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ভাইরাসের প্যানডেমিক পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, সেসব মহামারি এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেই বিবেচনায় হয়তো বলা হচ্ছে যে, এটাই হয়তো শেষ বছর। কিন্তু এখানে অন্য প্রশ্নও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দুটো সম্ভাবনা আছে। আমরা ওমিক্রনের যত মিউটেশন দেখছি, সেটি আবার ততোই সংক্রমিত হচ্ছে। যখনই ভাইরাস ব্যাপক ট্রান্সমিশনে থাকে, তখন ভাইরাসের আরও বেশি মিউটেশনের সম্ভাবনা থাকে। তখন হয়তো ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আবার শক্তিশালীও হতে পারে। এ কারণে প্যান্ডেমিক শেষ হয়ে যাচ্ছে কীনা সেটা বলার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে এখনও প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ লাখের ওপর রোগী হচ্ছে; পাঁচ থেকে সাত হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, সেখানে কোনো ভ্যারিয়েন্ট দুর্বল হয়ে যাচ্ছে- এই ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো সময় এখনও আসেনি।’
এর পেছনে মূল কারণ দুটো: একদিকে ভাইরাসের দুর্বল হয়ে পড়া এবং অন্যদিকে ভাইরাসের হোস্ট, অর্থাৎ মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বৃদ্ধি।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দুই বছরে পৃথিবীর ৩২ কোটিরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং এর হাত থেকে রক্ষা পেতে বহু মানুষ টিকা নিয়েছেন। ফলে তাদের দেহে ভাইরাসটি প্রতিরোধ করার জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়েছে।
এটিকে প্রতিরোধের জ্ঞানও তৈরি হয়েছে মানুষের দেহে।
চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন নতুন এই ভাইরাসটির উৎপত্তি হয় তখন দেহের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থার কাছে এটি ছিল একেবারেই অচেনা অজানা, ছিল সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাইরাস এবং এর সাথে কিভাবে লড়াই করতে হবে সেই জ্ঞানও তাদের ছিল না। একইসঙ্গে এর কোনো ওষুধ ছিল না, ছিল না কোনো টিকাও।
কিন্তু এর মধ্যে মানুষের দেহে কোভিড মোকাবেলার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা এখন ভাইরাসটি সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি জানে। এটিকে পরাস্ত করার অভিজ্ঞতাও তাদের হয়েছে।
প্রতি মুহূর্তের এই লড়াইয়ের ফলে ভাইরাসটি রূপান্তরিত হতে হতে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে ওমিক্রন ধরনের কথাই উল্লেখ করা যেতে পারে। এটি আগের যে কোনো ধরনের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক হলেও রোগীকে আগের মতো কাবু করতে পারে না।
এই ধরনে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর হারও অনেক কম। কিন্তু সারা বিশ্বেই কি প্রতিরোধের এই চিত্রটা একই রকমের?
পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় দরিদ্র দেশগুলোতে খুব কম সংখ্যক মানুষই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এসব দেশে টিকাও দেয়ার হারও অনেক কম। ফলে দরিদ্র দেশগুলোতেও মহামারি এখন শেষ পর্যায়ে- একথা কি বলা যাবে?
আইইডিসিআরের বিজ্ঞানী আলমগীর বলেন, সারা বিশ্বে এখনও কিন্তু সমানভাবে টিকা দেয়া যায়নি।
তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিক সংক্রমণ থেকে যে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, সেটা কিন্তু বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তবে যদি আমরা টিকার পরিমাণ বাড়াতে পারি, বিশ্বের অন্তত ৭০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারি, তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হবে।’
যা হোক, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন দিয়ে অনেক বিজ্ঞানী ভাইরাসটি শেষ দেখলেও উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে। তাই একটি প্রশ্ন মনে উঠতেই পারে- ওমিক্রনে কি করোনার শেষ, নাকি শাশ্বত হয়ে ওঠার শুরু?
Leave a Reply